শীতলক্ষ্যায় ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার হয়েছে গতকাল। সঙ্গে সারি সারি লাশ। নারায়ণগঞ্জের মদনঘাট এলাকায় স্বজনহারা মানুষে আহাজারির সম্পর্কে আমরা কম বেশি সবাই অবগত। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে মালবাহী কার্গোর ধাক্কায় লঞ্চডুবির ঘটনায় আরও ২৪ মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
এ নিয়ে এই দুর্ঘটনায় ২৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হলো। সোমবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’র সহায়তায় উল্টো করে লঞ্চটি নদীর পূর্বপারে আনা হয়। এরপরই লঞ্চটির ভেতর থেকে মৃতদেহ বের করতে শুরু করেন উদ্ধারকারীরা।
নারায়ণগঞ্জ নৌ পুলিশের ওসি মো. শহীদুল ইসলাম জানান, মোট ২৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সব লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্ধার অভিযান অব্যাহত আছে, যতক্ষণ না নিখোঁজদের পাওয়া যাচ্ছে। যে জাহাজটি ধাক্কা দিয়েছে ভিডিও ফুটেজ দেখে আমরা সেটিকে শনাক্ত করেছি। সেটিকে আটক করতে অভিযান চলছে।’
লঞ্চডুবির ঘটনায় নিহতরা হলেন- মুন্সীগঞ্জের কোর্টগাঁও এলাকার দোলা বেগম (৩৪), সদরের রুনা আক্তার (২৪), মোল্লাকান্দির সোলেমান বেপারী (৬০), তার স্ত্রী বেবী বেগম (৬০), মালপাড়ার সুনিতা সাহা (৪০), তার ছেলে বিকাশ সাহা (২২), উত্তর চরমসুরার পখিনা (৪৫), একই এলাকার বীথি (১৮), তার এক বছর বয়সী মেয়ে আরিফা, সদরের প্রতিমা শর্মা (৫৩), সাদিয়া আক্তার (১১), মোল্লাকান্দি চরকিশোরগঞ্জের মো. শামসুদ্দিন (৯০), তার স্ত্রী রেহেনা বেগম (৬৫), দক্ষিণ কেওয়ারের নারায়ণ দাস (৬৫), তার স্ত্রী পার্বতী দাস (৪৫), সদরের শাহ আলম মৃধা (৫৫), একই এলাকার মহারানী (৩৭), ছাউদা আক্তার লতা (১৮), খাদিজা বেগম (৫০), বরিশালের উটরা উজিরপুরের হাফিজুর রহমান (২৪), তার স্ত্রী তাহমিনা (২০), তাদের এক বছর বয়সী শিশুপুত্র আবদুল্লাহ, নারায়ণগঞ্জের বন্দরের কল্যান্দী এলাকার দুই বছরের শিশু আজমির (ঘটনার সময় সঙ্গে থাকা দাদা সাইফুল ইসলাম বেঁচে গেছেন), ঢাকার শনিরআখড়ার আনোয়ার হোসেন (৪৫), তার স্ত্রী মাকসুদা বেগম (৩০), তাদের ৭ মাস বয়সী মেয়ে মানসুরা, শরীয়তপুরের নড়িয়ার আবদুল খালেক (৭০), ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার মোছা. জিবু (১৩) ও নারায়ণগঞ্জের বন্দরের সেলসারদীর মো. নয়ন (১৯)।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সোমবার সকাল থেকেই শীতলক্ষ্যার উভয় তীরে অপেক্ষমাণ হাজারো মানুষের ভিড় ছিল। লঞ্চটি নদীর তলদেশ থেকে উদ্ধার করতে দেরি হওয়ায় স্বজনরা কখনো কখনো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তবে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ক্রেনের সাহায্যে লঞ্চটি পানির ওপর তুলে আনার পর স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, বিআইডাব্লিউটিএ, নৌ পুলিশসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়। লঞ্চ থেকে একে একে যখন লাশগুলো উদ্ধার করে তীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন কান্নায় ভেঙে পড়ে স্বজনরা।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে লাশ হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা বারি বলেন, ‘লঞ্চডুবিতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই মুন্সীগঞ্জের অধিবাসী। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত স্বজনদের কাছে আমরা ২৯টি মরদেহ হস্তান্তর করেছি।’ তিনি জানান, গত দুই দিনে স্বজনদের কাছ থেকে ৩৩ জন নিখোঁজের তালিকা পায় জেলা প্রশাসন, যার মধ্যে ২৯ জনের লাশ এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর চর সৈয়দপুর কয়লাঘাট এলাকার নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুসংলগ্ন স্থানে একেএল-৩ নামের একটি কোস্টার জাহাজের ধাক্কায় অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় সাবিত আল হাসান নামের লঞ্চটি। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত পাঁচ নারীর লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীরা। রাতেই ঘটনাস্থলে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় পৌঁছলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছিল। পরে গতকাল সকাল থেকে উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়।