১৯, মার্চ, ২০২৪, মঙ্গলবার
     

ওষুধের ‘এই অসুখ’ সারাবে কে?

শুধু ভোগপণ্য কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নয়, সব কিছুর সঙ্গে নীরবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওষুধের দামও।

অতি জরুরি বিষয় হওয়ার কারণে ভোক্তারা ওষুধের দাম নিয়ে দরকষাকষির সময় ও সুযোগ কোনোটিই পান না। যে কারণে বছরের পর বছর ধরে ওষুধের বাজার অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন।

বিশেষ করে মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিশেষ কমিটি ছয় বছর আগে বিলুপ্ত করায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর অবস্থা অনেকটা পোয়াবারো। অবস্থাদৃষ্টে যাকে অনেকে মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

এদিকে দাম নিয়ে তদারকি করার যেহেতু কেউ নেই, তাই ঔষধ প্রশাসনও এক রকম নির্বিকার নিধিরাম সর্দারের ভূমিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরাও জোড়াতালি দিয়ে দায় সারছেন।

দাম নিয়ন্ত্রণে তাদের সক্ষমতা না থাকার খোঁড়া যুক্তিই শেষ কথা। ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট জানিয়েছেন, ওষুধের অব্যাহত দাম বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের একটি অংশ ওষুধ কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে।

যে সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। হতদরিদ্র মানুষের কথা বাদ দিলেও এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকে ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে বড় কোনো অসুখ হলে সাধারণ সঞ্চয় দিয়ে সংকট সামলানো যায় না। অনেকে জমিজমা বিক্রিসহ সর্বস্ব খুইয়েও সুস্থ হতে পারেননি। বিদ্যমান বাস্তবতায় এ সংখ্যাটা কম নয়।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘গরিবের ওষুধ বলতে কিছু নেই। ওষুধ সবাই খায়। সরকার নিয়ন্ত্রিত যে ওষুধগুলো আছে, সেগুলোর খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে সরকার। তাছাড়া বিভিন্ন কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত ওষুধের দাম, সরাসরি সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না।

তবে বিগত বছরগুলোতে যেসব ওষুধের মূল্য বেড়েছে, এর কোনো তথ্য-উপাত্ত আমাদের কাছে নেই। মূল্য বাড়ছে, এক টাকা, ২ টাকা, ৫ টাকা বাড়ছেই। মূল্য বৃদ্ধি কোনো ওষুধের হচ্ছে, এগুলো জানা, ডাটাবেজ করতে হলে লোকবলের সঙ্গে সরঞ্জামও লাগবে, যা আমাদের নেই।’

ঔষধ প্রশাসনের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, তাদের তথ্যমতে ২০১৮ সালে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের দাম অনেকটা বেড়ে যায়। যার যুক্তি ছিল বিশ্ব বাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি। তবে ওই অজুহাতে শুধু সেসময় একদফা দাম বাড়েনি।

ভুক্তভোগী মহলের অনেকের সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দাম বৃদ্ধির অজুহাত রীতিমতো পাগলা ঘোড়ায় রূপ নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় এই পাগলা ঘোড়া থামছে না। এখন তো আবার যুক্ত হয়েছে বিশ্বের যুদ্ধ পরিস্থিতি।

বেশ কয়েকজন বিক্রয় প্রতিনিধি প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ওষুধের দাম আরও বাড়বে। তারা তাদের কোম্পানির তরফ থেকে এমন বার্তা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছেন। যে কারণে বাজারে সারা বছর চাহিদা থাকে এমন ক্যাটাগরির বেশকিছু ওষুধ অনেকে আগাম কিনে সংরক্ষণ করছেন। বলা যায়, অনেকটা সয়াবিন তেল মজুত করে রাখার মতো ঘটনা। যদিও এসব নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।

এদিকে চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য পেয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে গত এক মাস যাবত রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মেডিসিন সেলস পয়েন্টে সরেজমিন অনুসন্ধান করা হয়। ওষুধের দোকানে উপস্থিত ক্রেতা ছাড়াও প্রথম সারির বেশ কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েও রোগী এবং তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিবেদক।

সরেজমিন জানা যায়, দেশি ওষুধের মধ্যে সেফট্রোন ট্যাবলেট এক বছরের ব্যবধানে এক পাতার দাম ১৯০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫০ টাকা, গ্যাসের ওষুধ সেকলো প্রতি ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা, ফিনিক্স ৫০ টাকা থেকে ৭০ টাকা, প্যানটোনিক্স ট্যাবলেট ৫ টাকা থেকে বেড়ে ৭ টাকা, লুমুনা ১১ টাকা থেকে ১৬ টাকা, স্লাভিয়াসেফ ৫০ টাকা থেকে ৫৫ টাকায় পৌঁছেছে।

‘পোজমা ১০০ এমএল সিরাপ’ ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, শ্বাসকষ্টের ওষুধ ‘রুপা-১০ এমজি’ ১০ থেকে ১২ টাকা, ‘ক্যালবো’ ট্যাবলেট ৪০ থেকে ৫০ টাকা ‘মারবেন ১০০ এমজি’ একপাতা ওষুধ ৪০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা হয়েছে। প্রিগাবেন এক পাতা ১৬০ থেকে ১৯০ টাকা, ডুয়োপ্রেস ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা, ফিলনর ২৭০ টাকা থেকে ২৯০ টাকা, ইভাপ্রেক্স ২৭০ টাকা থেকে ২৯০ টাকা, এনজিটর ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। একটি অ্যান্টাজল ড্রপ ১০ টাকা থাকলেও এখন ২০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে।

জ্বর-ব্যাথার জন্য সাধারণ প্যারাসিটামল থেকে শুরু করে গ্যাস, পেটের সমস্যা, হৃদরোগ, অ্যান্টিবায়োটিক, রক্তাল্পতা, ত্বকের ওষুধ নিতে সাধারণ মানুষের বাজেটের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব ওষুধও ফার্মেসি থেকে দামে বিক্রি হচ্ছে। অ্যাজমাসল (২০০) ১৯৫ টাকার স্থলে দাম বেড়ে ২৩০ টাকা পৌঁছে।

নিউরো-বি ১৮০ টাকা থেকে বেড়ে ২৪০ টাকা, নিউরো ক্যাল ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২৪০ টাকা, রসুভাস (১০) ১৫০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা, রসুভাস (৫) ৮০ থেকে ১০০ টাকা, টোসার ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা, অ্যাডোভাস ৫৫ টাকা থেকে ৬৫ টাকায় পৌঁছেছে। এসব ওষুধ নিয়মিত কেনেন এমন বেশ কয়েকজন জানান, গত ১ বছরের মধ্যে এ সমস্ত ওষুধের বড় অংশের দাম বেড়েছে অন্তত ১৫-২০ শতাংশ।

গত কয়েক বছরের হিসাব ধরলে, এই বৃদ্ধির হার আরও চড়া। বাড্ডা লিংক রোডস্থ এক ওষুধ বিক্রেতার ভাষ্য, ‘বাজারের অন্যান্য জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির হারের থেকেও অনেক ক্ষেত্রে ওষুধের দর বেড়েছে বেশি। সাধারণ মানুষ অসহায়। কারণ, ‘পেটে না-খেয়েও’ ওষুধ কেনা ছাড়া তো গতি নেই।

অপরদিকে বিদেশি ওষুধের দাম একেবারেই লাগামছাড়া। এসব ওষুধস্বল্পতা দেখিয়ে কাস্টমারকে এক প্রকার জিম্মি করে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি দাম রাখা হচ্ছে। আইসিইউতে থাকা রোগীদের চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে অ্যাকট্রেমা ইনজেকশন, যা পরিমাণের ভিত্তিতে ২১ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আবার এটির কৃত্রিম সংকটও তৈরি করে বিক্রি করা হয় ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়।

বিদেশি ওষুধ ‘অ্যাকট্রেমা’ দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এজাসিটি ইনজেকশন সাড়ে ৪ হাজার টাকা থেকে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৯ হাজার টাকায়। ফরজিকা ৪০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা, টেমিফ্লু ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা, সানিলক এসপিএফ ১৭৫০ টাকা থেকে ২২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

এসব ওষুধ বিক্রিও হচ্ছে দেদার। এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার ভাষ্য ‘আমদানি করা ওষুধের গায়ে বাংলাদেশি টাকায় মূল্য লেখার নিয়ম রয়েছে, কিন্তু লেখা হয়নি। রোগীরা বাধ্য হয়ে এসব ওষুধ কেনে। বিদেশি ওষুধ এক প্রকার লুকিয়ে রাখে। সংকট দেখিয়ে চড়া মূল্যে বিক্রি করে। আমাদের কিছুই করার থাকে না।’

গুরুত্বপূর্ণ মেডিসিন পয়েন্টে ওষুধের দাম বাড়ার তথ্য সংগ্রহের সময় সাংবাদিক পরিচয় জেনে বেশ কয়েকজন ক্রেতা তাদের ক্ষোভ কথা তুলে ধরতে চান। শাহবাগ মোড়ের ওষুধের দোকানে আসা মধ্যবয়সি জমির শেখ যুগান্তরকে বলেন, ‘এসব লিখে কী হবে? আমি তো ওষুধ কিনতে কিনতে ফকির হয়ে গেলাম। আরে ভাই স্ত্রীর জন্য প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। আমার কথা বাদ দিলাম। আমি অ্যাজমার রোগী।

তিনি জানান, ছোটখাটো ব্যবসা করেন। মাসে বড়জোর আয়রোজগার হয় ২০-২৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে যদি ওষুধ কিনতে এভাবে টাকা গুনতে হয় তাহলে খাব কী।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দোকানদারের সামনে তার হাতে কয়েকটি ওষুধ দেখিয়ে বলেন, দেখেন এই ওষুধটা আগে কিনতাম ৫০ টাকা পাতা। আর এখন কিনতে হচ্ছে ৭৫ টাকা।’

এদিকে জমির শেখ এর কথা শেষ না হতেই পেছন থেকে আর এক জন বলেন, ‘ভাই একটু ভালো করে লেখেন। গরিব মানুষের সব দিক দিয়ে কষ্ট। বাজারে আগুনের মধ্যে ওষুধের দোকানেও আগুন। নামে সব সরকারি হাসপাতাল। অথচ কোনো ওষুধ নেই। ডাক্তার যেই ওষুধ দেন তার সবই বাইরে থেকে কিনতে হয়। হাসপাতালের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, গত মাসে আমার ছোট ছেলে এখানে ভর্তি ছিল।

কিন্তু সব ওষুধ এই দোকান থেকে কিনতে হয়েছে। মতিঝিল জসিম উদ্দিন রোড এলাকায় থাকেন রেজিনা বানু। জানালেন, ছোট্ট একটি রুমে ৭ হাজার টাকায় ভ্যানচালক ছেলে-ছেলের বউ নিয়ে ভাড়া থাকেন। হাঁপানি রোগ তার। এখন ওষুধের দাম বাড়ায় কিনে খেতে পারেন না। হাতিরঝিল এলাকার ফার্নিচার ব্যবসায়ী সেলিম চৌধুরী জানান, রোজগারের প্রায় অর্ধেক টাকা ওষুধ কিনতে ব্যয় হয়। ভাত কম খেয়ে থাকা যায়, কিন্তু ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ খেতেই হয়।

এদিকে ওষুধের দাম বৃদ্ধি নিয়ে হাসপাতাল পাড়ায় ক্ষোভ অসন্তোষ আরও বেশি। গত ১০ মে থেকে ১৮ মে পর্যন্ত রাজধানী ৪টি অভিজাত হাসপাতালসহ আরও কয়েকটি বড় বড় হাসপাতাল ঘুরে বিচিত্র তথ্য মেলে অনুসন্ধানে। প্রতিটি হাসপাতালের ভেতরে এখন মেডিসিন সেলস পয়েন্ট রয়েছে। যথারীতি হাসপাতালের বাইরে ওষুধের দোকানের ছড়াছড়ি অবস্থা। গত মঙ্গলবার দুপুরে একটি হাসপাতাল থেকে হন হন করে বের হচ্ছিলেন এক রোগীর স্বজন। ওই সময়ে তিনি মুঠোফোনে একজনকে বলছিলেন, ‘মা রে এই টাকায় কিচ্ছু হইব না।

টাকা আরও লাগব। একটা ইনজেশনের দাম ৬০ হাজার টাকা। তোর এই ২০ হাজার টাকায় কী হবে।’ অপর প্রান্তের কথা শোনার পর তার চোখে পানি। ফোন রেখে বসে পড়লেন হাসপাতালের গেটের পাশে গাছেন নিচে।’ তার কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম। সাংবাদিক পরিচয় শুনে তার কান্না তখন আছড়ে পড়ছিল। হাত ধরে বললেন, ‘আার নাতিরে বাঁচান। ৫টা ইনজেকশন লাগব। অনেক দাম। আমি যে এহন কী করুম…।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে একজন ওষুধের দোকানদার যুগান্তরকে বলেন, এসব ইনজেকশনের দাম অনেক বেশি। আগে একটু কম ছিল। এখন অনেক বেশি। এসব ওষুধ গরিব কেন মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকে কিনতে পারবে না। তিনি বলেন, সরকারিভাবে যেসব ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পর্যায়ে শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকা প্রয়োজন, তেমনি দামি ওষুধের একটা ওষুধ ব্যাংক থাকা দরকার। জরুরি প্রয়োজনে গরিব মানুষকে সেবা দিতে এটা খুবই দরকার।

ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সহসভাপতি আব্দুল হাই যুগান্তরকে বলেন, ‘দেশে ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দু’ভাবে। এক. সরকার আরেক ওষুধ কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা। কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে, বিভিন্ন কৌশলে তা অনুমোদন নিয়ে নেয়।

২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত দেশে একটা ওষুধ মূল্য নির্ধারণ কমিটি ছিল। কিন্তু ৬ বছর পার হয়ে গেলেও নতুন কোনো কমিটির দেখা মেলেনি। তিনি জানান, ‘আগে কমিটি প্রতিমাসে দু’বার মিটিংয়ে বসত, যা এখন অতীত। ওষুধ প্রশাসন দাম বাড়ানোর প্রস্তাব যাচাই করার কথা বললেও আসলে যা প্রস্তাব আসে তাই অনুমোদন করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘গত ২-৩ বছর ধরে ওষুধের দাম লাগাতার বাড়ছে। কোম্পানির দেওয়া মূল্য নির্ধারণ নড়চড় করার ক্ষমতা কারও নেই। বছরে ২-৩ বার যদি দাম বাড়ায়, ফার্মেসিওয়ালাদের কিছুই করার থাকে না। বরং তাদেরকে সাধারণ মানুষের বকা শুনতে হচ্ছে। প্রতি বছর ১০ থেকে ২০ শতাংশ ওষুধের দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে।’

আব্দুল হাই বলেন, ‘এক সময় বিক্রেতাদের ১৬ শতাংশ কমিশন দেওয়া হতো, কিন্তু এখন ১০ থেকে ১২ শতাংশ দেওয়া হয়। কোম্পানি ওষুধ বিক্রির পর ভ্যাট দেয়। আর বিক্রেতা তথা ওষুধ ব্যবসায়ীরা আগে ভ্যাট দিয়ে ওষুধ কিনে বিক্রি করে। সাড়ে ১৭ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে ওষুধ কিনতে হয়। এটাও কিন্তু বড় সমস্যা, যা অনেকে জানে না।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘১১৭টি ওষুধ সরকার মূল্য নির্ধারণ করে। বাকি প্রায় ১৫শ কোম্পানির ৩৭ থেকে ৪২ হাজার ব্যান্ড’র ওষুধ রয়েছে। ১৫শ কোম্পানির ওষুধের দাম কোম্পানির মালিকরাই নির্ধারণ করে। যাচাই-বাছাই করে তাদের নির্ধারিত ওষুধের দাম আমরা অনুমোদন দিয়ে থাকি। এমআরপি, আইপি এ দুই পদ্ধতিতে ওষুধের দাম লেখা থাকে। তবে কোম্পানিগুলো বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের তেমন কিছুই করার নেই। ওষুধটুকু পারি যাচাই করি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি মানে সাধারণ মানুষের ওষুধ সেবনে বাধা। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, পারবেও না। ১১৭টি ওষুধ বাদ দিয়ে দেশে যে পরিমাণ ওষুধ তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ কোম্পানিই করে। সংশ্লিষ্টরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে, কোম্পানির দেওয়া মূল্যে হাত দেওয়ার ক্ষমতাও নেই সংশ্লিষ্টদের। এখানে ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি অনুযায়ী ওষুধের মূল্য নির্ধারণ হলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হতো।’

তিনি বলেন, ‘ বিশ্বের যে কোনো দেশে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা করা ছাড়াও ওষুধগুলোর দাম নির্ধারণ করে সরকার। এটাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম। আমাদের দেশের ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতেও তা ছিল। কিন্তু, ১৯৯৪ সালে ওষুধ কোম্পানির দাবির মুখে বলা হলো, ১৭ শতাংশ ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করবে, বাকিটা করবে কোম্পানি। এটাকে বলা হলো ইন্ডিকেটিভ প্রাইস। এ রকম আজগুবি নিয়ম দুনিয়ার কোথাও নেই’। তিনি মনে করেন, একই সঙ্গে এমন একটি কমিটি গঠন করা হোক, যে কমিটির সদস্যরা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর তথা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। যে কমিটিতে সরকারের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, সাধারণ মানুষ তথা রোগীদের প্রতিনিধিও থাকতে পারবে।’

প্রসঙ্গত, ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় নির্দেশনায় বলা হয়, অত্যাবশ্যকীয় তালিকাবহির্ভূত ওষুধের দাম উৎপাদক প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে। সেই নির্দেশনাকে পুঁজি করে প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো দাম বাড়ায়। ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ অনুযায়ী যে কোনো ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা একমাত্র সরকারের ছিল। কিন্তু ৯৪-এর আদেশের পর থেকে ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা নিজেদের মতো দাম নির্ধারণ করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানায়। প্রায় ২৫ বছর ধরে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা মিলে যে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সেই দামেই বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে। অথচ যথেচ্ছ মূল্য নির্ধারণ নিয়ন্ত্রণ করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যে কমিটি ছিল তা রহস্যজনক কারণে ২০১৬ সালে বিলুপ্ত করা হয়। ওই কমিটিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রতিনিধি, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা কোম্পানির প্রতিনিধিগণ থাকতেন।যুগান্তর

               

সর্বশেষ নিউজ