দেশে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। দুবছর আগে পলিথিন এবং একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা নিতে এক বছর সময় বেঁধে দেন উচ্চ আদালত। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে পলিথিনের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে আন্তর্জাতিকমহল থেকে তাগিদ আছে। এতকিছুর পরও এবারের বাজেটে এসেছে উলটা প্রস্তাব। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ (ওভেন প্লাস্টিক ব্যাগসহ) ও মোড়কসামগ্রীর ওপর বিদ্যমান ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হয়। এটি বাড়ানোর পরিবর্তে কমিয়ে ১ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের পরিবেশের জন্য এটা কেবল দুঃসংবাদই নয়, স্ববিরোধী অবস্থান। এ ব্যাপারে উদারনীতি পলিথিনের ব্যবহার বাড়াবে। ফলে পরিবেশদূষণ আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে। পরিবেশের প্রধান তিন উপাদান মাটি, পানি ও বায়ুদূষণ বাড়বে। আর এর প্রভাব বংশানুক্রমিক পরবর্তী প্রজন্মকে ভোগ করতে হবে। তারা পলিথিনের ওপর শুল্ক আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেন। পাশাপাশি পলিথিনের বিকল্প ব্যবহার উৎসাহিত করতে পাটের তৈরি ব্যাগ ও জিওব্যাগ, কাগজের ব্যাগ-প্যাকেট প্রভৃতি খাতে প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শ দেন।
জাতিসংঘের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, পলিথিনের ওপর কর বাড়ানোর পরিবর্তে বাজেটে এভাবে রেয়াতের প্রস্তাব নিঃসন্দেহে স্ববিরোধী অবস্থান। এমনিতেই প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের একটি। একটি পলিথিন একশ বছরেও পচে না। এই সময়ে এটি মাটির যেখানেই থাকে, সেখানেই ক্ষতি করে। এ কারণে উর্বরতা কমে ফসলের ফলন কমাবে। ইতোমধ্যে মাছের পেটে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। সাগর থেকে আহরিত লবণেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আর পোড়ালে তা বায়ুদূষিত করে। সবমিলে পলিথিন এক ভয়ংকর বস্তুর নাম। তাই সারা বিশ্ব এর বিরুদ্ধে সোচ্চার। বিষয়টি উপলব্ধি করে দুই দশক আগে বাংলাদেশেই এটার ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন হয়েছে। সেখানে উদারনীতির প্রস্তাব বিস্ময়কর। তিনি পলিথিনের পরিবর্তে এর বিকল্প পণ্য উৎসাহিত করতে প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শ দেন।
অবশ্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, বাজেটে যে পলিথিনের ওপর শুল্ক কমানোর প্রস্তাব এসেছে তা শপিং ব্যাগ নয়। বিদেশে যে পণ্য রপ্তানি করা হয়, তা মোড়কের পলিথিন এটি। যোগাযোগের পর সংশ্লিষ্টরা আমাদের এমনটিই জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে কাঁচাবাজার, মুদিদোকান, শপিংমল, চেইনশপসহ এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে না। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এর ব্যবহার বেড়েছে তিনগুণের বেশি। ২০০২ সালে নিষিদ্ধের পর কিছুদিন হাতে ঝুলিয়ে ব্যবহার উপযোগী পলিথিন ব্যাগ বন্ধ ছিল। কিন্তু বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি, কিছুদিন পরই সেই ব্যাগও বাজারে ফিরে এসেছে। যদিও পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে ক্ষতিকর এ পণ্য নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালায়। কিন্তু এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার এতটুকুও কমেনি।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশদূষণের কারণে ২০১৯ সালেই বাংলাদেশে দুই লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালে এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্সে (ইপিআই) চরম ঝুঁকিপূর্ণ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০তম। বায়ুদূষণে ঢাকা শহর মাঝেমধ্যেই প্রথম বা দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসে। বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায়ও এই শহরের অবস্থান তলানিতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী পরিবেশদূষণ। আর পরিবেশদূষণের যেসব কারণ আছে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পলিথিন। তারা আরও বলছেন, বাংলাদেশ সুনীল অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছে। এবারের বাজেটেও এ বিষয়ে আলাদা বক্তব্য আছে। কিন্তু এই সমুদ্রসম্পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রেও অন্যতম দায় পলিথিন। ইতোমধ্যে একাধিক গবেষণায় লবণে এবং মাছে প্লাস্টিকের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। আমরা যে পলিথিন ব্যবহার করি, তা নগর বন্যার জন্যও কম দায়ী নয়। এই পলিথিন নদী হয়ে সাগরে যায়। এই পক্রিয়ায় সাগর দূষণে বিশ্বে ষষ্ঠ স্থানে আছে বলে গবেষণা বলছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর ৮০ শতাংশ পলিথিনই মাটিতে ফেলা হচ্ছে। বছরে ১৭ হাজার টন পাতলা প্লাস্টিক ও পলিথিন মাটিতে পড়ছে। যার ৭৩ শতাংশ মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার ও উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার পরামর্শ ও কর্মপরিকল্পনা দেওয়া হয়।
পলিথিনে শুল্ক কমানোর প্রসঙ্গে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, পলিথিন মাটি, পানি, বায়ুকে সমানভাবে দূষিত করে। পলিথিন ইতোমধ্যে খাদ্যশৃঙ্খলের মধ্যে চলে এসেছে। গবেষণায় ধানমন্ডির লেকের পানির মাছে আমরা পলিথিন পেয়েছি। ঢাকার পাশের বুড়িগঙ্গা আর ধলেশ্বরীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী বলেই ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনা থেকে পানি আনতে হচ্ছে ঢাকায়। পলিথিনের আধিক্যের কারণে ঢাকার আবর্জনা থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা যাচ্ছে না। সুতরাং যে জিনিস একবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা উৎসাহিত করে নিজেদের মৃত্যু ত্বরান্বিত না করাই শ্রেয়। বাজেট অনুমোদনকালে শুল্ক না কমিয়ে আরও বাড়িয়ে দেবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষা কেবল আইন করে সম্ভব নয়। আইনের বাস্তবায়ন ও মানুষকে এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতায় সরকারের পদক্ষেপ জরুরি।- যুগান্তর