জামায়াত ছাড়া চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি বা অন্য যে কোনো দল থেকে এসে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া যাবে। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদও পাবেন তারা। তবে বড় পদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
নবাগতদের সুবিধা দিতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের কট্টর নীতিগত অবস্থান থেকে সরে আসছে। ফলে টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে আওয়ামী লীগে যোগদানকারীদের এতদিন ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘হাইব্রিড’ বলে ব্যঙ্গ করা হলেও দলে তাদের অবস্থান শক্ত হচ্ছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে যুগান্তরকে জানিয়েছেন দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা।
তারা আরও জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে বড় ধরনের ছাড় পাচ্ছেন অতীতে জাতীয় সংসদ, উপজেলা এবং পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থানকারী নেতাকর্মী ও বিদ্রোহী প্রার্থীরাও।
তাদেরকে আওয়ামী লীগে সক্রিয় করা হচ্ছে। দলের চলমান জেলা ও উপজেলা সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পদও পাবেন নবাগতরা। আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শে বিশ্বাস করে যোগ দেওয়া এসব ব্যক্তিকে আর অনুপ্রবেশকারী হিসাবে বিবেচনা করা হবে না।
তাদের ব্যাপারে নমনীয় হতে সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদকরা বিভক্তি দূর করে তৃণমূল আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে জিততে হলে আমাদের ভোট দরকার। তাই দলের সদস্যপদ রুদ্ধ করে রাখা ভোটের রাজনীতির জন্য সুখকর নয়। আমাদের দলের মৌলিক রাজনৈতিক চেতনা ধারণ করে কেউ যদি আসতে চায়, তাহলে তা ইতিবাচক বলে ধরা হবে। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি যারা, তারা ‘হার্মফুল’। তারা দলের জন্য ক্ষতিকারক। এদের কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না।’
নবাগতরা কি দলীয় পদ পাচ্ছেন-এমন প্রশ্নের জনাবে তিনি জানান, দলের লোক হতে হলে যে আওয়ামী লীগের পদ পেতেই হবে এমন নয়। পদ পাওয়ার যোগ্য কি না, তা যাচাইয়ের বিষয় রয়েছে।
কাউকে পদপদবি দেওয়ার আগে বিবেচনা করা হয়, তার ভূমিকা, সাংগঠনিক ক্ষমতা, কতদিন ধরে রাজনীতি করছেন প্রভৃতি বিষয়।
আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনীতি করে, তারা যেখানেই অর্থাৎ যে রাজনৈতিক দলেই থাকুক, আওয়ামী লীগের দরজা তাদের জন্য বন্ধ নয়। তাদের অনুপ্রবেশকারী হিসাবে দেখা হয় না। তবে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়ায়, তাদের জায়গা আওয়ামী লীগে হবে না।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে, জাতির পিতার অবিনাশী আদর্শ বিশ্বাস করবেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল, সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের তথ্যপ্রযুক্তি ও মানবসেবা এবং নৌকার প্রতি আস্থাশীল, তারা আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হওয়ার যোগ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা মৌলবাদী আচরণ করে আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে কমিউনিস্ট পার্টি ও মুসলিম লীগের ভাগ্যবরণ করাতে চান, তারা বিভ্রান্ত। তারা নিজের নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ভালো মানুষকে দলে অন্তর্ভুক্ত করাতে ভয় পান।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘নীতি ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে কেউ যদি আওয়ামী লীগে যোগ দিতে চায়, তাহলে তারা তা করতে পারে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সে অধিকার রয়েছে।’ বিএনপিসহ অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দল থেকে এসেও আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া যাবে বলে তিনি জানান।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অখণ্ডত্ব, জাতীয় সংহতি, রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও জননিরাপত্তাবিরোধী এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত রহিয়াছেন বলিয়া প্রতীয়মান নহেন; বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগকারী বা নাগরিকত্ব বাতিলকৃত ব্যক্তি নহেন; অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নহেন; ধর্ম, পেশা ও জন্মগত শ্রেণি ও বর্ণের ভিত্তিতে কোনো প্রকার বৈষম্যে বিশ্বাস করে না; আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থি কোনো সংগঠনের সদস্য নহেন; বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সদস্য কর্তৃক নির্দেশিত ন্যূনতম প্রশিক্ষণ গ্রহণে ও যে কোনো নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকিবেন। এবং ত্রিবার্ষিক চাঁদা নিয়মিত পরিশোধ করিবেন-তাহারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সদস্য হইতে পারিবেন।’
জানা যায়, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। এ সময় কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতা এবং সংসদ-সদস্যরা নিজেদের স্বার্থে, দল ভারী করার উদ্দেশ্যে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত-এমনকি বঙ্গবন্ধুর খুনির দল ফ্রিডম পার্টির নেতাদেরও নিজ দলে ঠাঁই দেন।
কোনো কোনো জেলা এবং উপজেলায় নবাগতরা দাপট দেখিয়ে পুরোনো এবং ত্যাগী নেতাকর্মীদের সরিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগে চালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ পর্যন্ত হয়েছেন। এ নিয়ে তৃণমূল থেকে শুরু করে দলের হাইকমান্ডেও অসন্তোষ রয়েছে। শীর্ষ নেতারা নবাগত বা অনুপ্রবেশকারীদের সম্পর্কে প্রকাশ্যে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তাদের রুখতে একাধিক চিঠিও গেছে তৃণমূলে। কিন্তু কিছু হয়নি।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের জন্য অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিড এবং দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থানকারী নেতা ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের যে সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে অবশ্য আওয়ামী লীগের সব নেতা একমত নন। নাম প্রকাশ না করে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য যুগান্তরকে বলেছেন, এই ‘এক্সপেরিমেন্ট’ দলের জন্য সুখকর হবে বলে তিনি মনে করেন না।-যুগান্তর