১৬, নভেম্বর, ২০২৪, শনিবার
     

‘ঋণে ঘি খাওয়া’ নীতিই কাল হয়েছে শ্রীলংকার

শ্রীলংকার বর্তমান সংকট মূলত অর্থনৈতিক সংকট, যা দুই-একদিনে তৈরি হয়নি। গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে চলা পুঁজিবাদী ও নব্য উদার অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণের কারণে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

বিশাল একটা সময় ধরে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও শিল্পের প্রতি অবহেলা করা হয়েছে। উপেক্ষা করা হয়েছে স্থানীয় কৃষিকে। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়নি। জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের বেসরকারিকরণ করা হয়েছে।

সর্বোপরি নব্য উদার ও সাম্রাজ্যবাদী আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং তাদের প্রভুদের বাতলে দেওয়া ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া’র নীতি, যার পরিণামে পর্বতসমান ঋণ সংকট তৈরি করেছে। এখন আমাদের সেই ঋণ শোধ করার টাকা নেই। ফলে চলতি বছরের মার্চেই আমরা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছি।

আমরা যদি ঋণ সংকটের দিকে দৃষ্টি দিই, তাহলে দেখতে পাব-২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই আমাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।

২০১৫ সালে যে ঋণের পরিমাণ ছিল ২৩ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯ সালে তা ৩৯ বিলিয়নে গিয়ে ঠেকে। অর্থাৎ মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলংকার এ ঋণ প্রধানত নেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকে, যার সুপারিশ করেছিল নব্য উদার অর্থনৈতিক প্রভুরা।

যে হারে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে, জিডিপি সেভাবে বাড়েনি। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে শ্রীলংকার জিডিপি ৭৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৪ বিলিয়ন ডলার।

ফলে ঋণ শোধ করার জন্য আরও ঋণ নিতে হয়েছে। শুধু ২০২২ সালেই আমরা ১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছি। কারণ শ্রীলংকাকে এখন প্রতিবছর ঋণই শোধ করতে হয় ৭ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে কমতে এখন মাত্র ১.৬ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ায়। ফলে বাধ্য হয়েই চলতি বছরের এপ্রিলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বাতিল করতে হয়।

এখন আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ প্রায় শূন্য। এ সংকট সৃষ্টিতে আরও বড় ভূমিকা রেখেছে সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয়ের পর প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব নেন গোতাবায়া রাজাপাকসে।

সরকারের প্রধানমন্ত্রী তার বড় ভাই সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে। অর্থমন্ত্রী হন তাদের ছোট ভাই বাসিল রাজাপাকসে। সেচ ও জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী করা হয় চমল রাজাপাকসেকে। যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক মন্ত্রী করা হয় নমল রাজাপাকসেকে। কৃষিবিষয়ক উপমন্ত্রী নিয়োগ করা হয় শাশে রাজাপাকসেকে।

প্রধানমন্ত্রীর চিফ অব স্টাফ হন ইয়োশিথা রাজাপাকসে। এভাবে রাজাপাকসে পরিবারের বহু আত্মীয়স্বজনকে অবৈধভাবে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয়।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যে সংকটে নিমজ্জিত শ্রীলংকা শেষ পর্যন্ত মহাবিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ডলারের বিপরীতে রুপির বিনিময় হার ঠিক রাখতে সরকার মাত্র দুই মাসের মধ্যে রিজার্ভ থেকে ৫.৫ বিলিয়ন বাজারে ঢেলেছে।

সেই সঙ্গে ছাপানো হয়েছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন রুপি। একই সময়ে রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করার মতো বোকা ও একগুঁয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সরকার, যার ফলে দেশীয় কৃষিজ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে।

এ অর্থনৈতিক সংকট দেশকে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের দিকে নিয়ে যায়। এখন যেটা অবশ্য করণীয়, তা হলো অবিলম্বে দেশকে রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল করা; যা দেশকে স্বাভাবিকভাবে চলার সুযোগ করে দেবে।

এর ফলে সংকট কাটিয়ে উঠতে জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করা যাবে। একই সঙ্গে দেশকে সংগঠিত করার সুযোগ দেবে। যার মাধ্যমে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা সম্ভব হবে।

তখন প্রবাসীদের থেকে রেমিট্যান্সের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহায়তাও পাওয়া যাবে। সমস্যা সমাধানে শুরুতে আমাদের দেশকে তার সঠিক পথে রাখতে হবে। এরপর সেবব সমস্যার সমাধান করতে হবে, যেসব কারণে দেশের শিল্প, পরিবহণ, শিক্ষা প্রভৃতি বন্ধ হয়ে আছে।

কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি প্রতিকারের জন্য অর্থনীতি, সরকার ও প্রশাসন এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর অবশ্যই সমাজতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে তিনটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। প্রথমত, অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে।

দ্বিতীয়ত, প্রশাসন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে। তৃতীয়ত, সম-অধিকার ও রাষ্ট্রের সব বিষয়ে সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে একটি জাতি গড়ে তোলা।

তবে সবকিছুর আগে যেটা করতে হবে তা হলো-বর্তমান অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের পদত্যাগ। স্পিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে পারেন। এরপর পার্লামেন্টের মাধ্যমে সীমিত সময়ের জন্য একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে হবে।

এরপর শিগগিরই একটা সাধারণ নির্বাচন দিতে হবে যাতে জনগণের পূর্ণ সমর্থনের মাধ্যমে একটা নির্বাচিত সরকার গঠন করা যায়। জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল একটা স্থিতিশীল সরকারই কেবল জনবান্ধব নীতি প্রণয়ন করতে পারে।

সংকট শুরু হওয়ার আগেই আমাদের দল (জনতা বিমুক্তি পেরামুনা বা জেভিপি, পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট) মানুষকে ব্যাপক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করেছে। একই সঙ্গে সরকারের একের পর এক গণবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেছে।

আমাদের এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল মূলত ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তখন আমাদের ট্রেড ইউনিয়নের ব্যানারে ভারত সরকারের প্রবল চাপের মুখে কলম্বো হার্বার জেটি ভারতীয় বিলিয়নিয়ার গৌতম আদানির হাতে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করে বিক্ষোভ হয়।

আমরা ওই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিই এবং বিজয়ী হই। এরপর বিভিন্নি কৃষক সংগঠনের অংশগ্রহণে জাতীয় পর্যায়ে মাসব্যাপী বিক্ষোভ হয়। সেটাও আমাদের দলের নেতৃত্বেই।

এরপর আরও ঐতিহাসিক শিক্ষক ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়, যা দেশের শিক্ষকসমাজের ব্যাপক সমর্থন এবং আমাদের ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

পার্লামেন্টে আমাদের সংসদ-সদস্যদের একটি গ্রুপ সেই ২০১৪ সাল থেকে রাজাপাকসে পরিবারের বড় বড় দুর্নীতির কথা প্রকাশ করে আসছে।

পার্লামেন্টকে ব্যবহার করে আমরা একদিকে জনগণকে সচেতন করেছি, অন্যদিকে রাজাপাকসেদের কদর্য দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা জারি রেখেছি।

পার্লামেন্টে আমাদের শক্তিশালী উপস্থিতি ও প্রভাবের ফলে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অন্যান্য বিরোধী দল ও সংসদ-সদস্যদের জনবান্ধব অবস্থানে নিয়ে আসতে পেরেছি।

শুধু তাই নয়, চলমান সংকটকালে আমরা বহু শান্তিপূর্ণ ও সুসংগঠিত বিক্ষোভ আয়োজন করেছি। মূলত এভাবেই জনগণের মধ্যে চলমান সমস্যাগুলোর ব্যাপারে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়েছে এবং এরপর তারা নিজেরাই

সরকার হটানোর লড়াইয়ে সংগঠিত হয়েছে। আমাদের দায়িত্ব এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। এরপর চলমান আন্দোলন যাতে পুঁজিবাদী ও স্বার্থান্বেষী দলগুলো কিংবা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও কিছু এনজিওর প্রক্সি তথা হাতের পুতুলে পরিণত না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখেছি।

এ বিক্ষোভ প্রধানত তিনটি স্তর বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রথমত, আমরা রাজনৈতিক দল ও জাতীয় পর্য়ায়ে সংগঠিত হয়েছি এবং সেটা সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয়ত, ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে সংগঠিত করা।

এক্ষেত্রে সারা দেশে অন্তত ২ হাজার ট্রেড ইউনিয়নকে সংগঠিত করে সেগুলোর নেতৃত্ব দিয়েছি। তৃতীয়ত, কলম্বোর গ্যালে ফেস বিক্ষোভ। মূলত উচ্চশিক্ষিত যুবক, ছাত্রছাত্রী, শিল্পী ও সাংস্কৃতিককর্মীরা এর নেতৃত্ব দিয়েছে।

তবে অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক ফ্যাক্টরও এ বিক্ষোভকে জোরদার করেছে। সরকার এবং একই সঙ্গে বিরোধী শক্তির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আমরা একে অপরের সঙ্গে মিলে কাজ করেছি।

অবশেষে আমরা সফল হয়েছি। শ্রীলংকার জনগণের প্রবল চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে আমাদের দল একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে।

বর্তমান সংকটে ভারত ও চীনের ভূমিকা নিয়ে জেভিপির দৃষ্টিভঙ্গি : ভারত শ্রীলংকার সবচেয়ে কাছের দেশ। শ্রীলংকার সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এ সংকটে ভারত শ্রীলংকার জনগণকে বেশ সহযোগিতা করেছে।

এজন্য ভারতের সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানাই। তবে আমরা সম্প্রতি দেখেছি, ভারতের সরকার ও ধনকুবেররা শ্রীলংকার জনগণের চেয়ে তার সম্পদের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।

আমরা আরও দেখেছি, শ্রীলংকা চলমান সমস্যা মোকাবিলায় সহযোগিতা করার চেয়ে তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য পরিস্থিতির ব্যবহার করতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে।

অন্যদিকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে চীন মূলত শ্রীলংকার সঙ্গে থেকেছে। শ্রীলংকার মোট বৈদেশিক ঋণের ১০ শতাংশই চীনের দেওয়া। ১০ বছর ধরে তারা আমাদের দেশে বহু অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণ করেছে।

সেগুলোর কিছু আমাদের কাজে এসেছে। কিছু প্রকল্প কোনো কাজেই আসেনি। বরং ওইসব প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। চীন সরকার মূলত রাজাপাকসে সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে। ফলে রাজাপাকসে পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে চীন সরকারকেও দুষছে লংকান জনগণ।-যুগান্তর

               

সর্বশেষ নিউজ