সৌদি ক্রাউন প্রিন্স এমবিএস বা মোহাম্মদ বিন সালমান ওয়াহবি দৃষ্টিভঙ্গীর ঊর্ধ্বে উঠে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে কোরআন বিশ্লেষণের তাগিদ দিয়েছেন। তিনি চান না পাথর মেরে, চাবুক মেরে, মুরতাদ এবং সমকামীদের হত্যা করা হোক।
এই ক্ষেত্রে হাদিসের সমসাময়িক ব্যাখ্যার ওপর জোর দিতে বলেছেন, প্রয়োজনে কোরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন সব হাদিস বাদও দিতে বলেছেন তিনি।
গত ২৭ এপ্রিল আল আরাবিয়া টিভিতে এক সাক্ষাৎকারে নিজের ২০৩০ ভিশন নিয়ে আলোচনা করেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান, যা ২০১৫ সালে নিজ দেশের সামনে পেশ করেছিলেন। এরই আংশ হিসেবে তিনি ইসলামিক আইনের প্রায়োগিক পরিবর্তন চান যা ১৮শ’ শতকের মুসলিম পণ্ডিত আবদুল ওয়াহাবের প্রবর্তিত ‘ইসলামি’ নীতি-নৈতিকতা বা ওয়াহাবিজম পরিপন্থী। যদিও সৌদি আরব এতদিন ওয়াহাবিজমকেই ইসলামি বিশ্বে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছিল।
ওই সাক্ষাৎকার নিয়ে এশিয়ানিউজে লিখেছেন কামেল আবদেররাহমানি।
সাক্ষাৎকারে নিজের ইসলাম সংস্কারের প্রয়াস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেক মুসলিম ফকীহ ও পণ্ডিতগণ হাজার বছর ধরে ইসলামি মধ্যপন্থার ধারণা নিয়ে কথা বলছেন। সুতরাং, আমি এখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা না করলেও এটুকু বলবো, কোরআন, সুন্নাহর ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত সৌদি সংবিধানকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চাই। ’
তিনি বলেন, ‘কোরআনই সৌদি আরবের সংবিধান, আমরা যে কোনোভাবেই হোক কোরআনের অনুশাসন বাস্তবায়নে বাধ্য। এই ক্ষেত্রে কোরআনের সুস্পষ্ট বিধানগুলোই কেবল বিবেচ্য হবে, সমাজ এবং ব্যক্তি জীবনের ক্ষেত্রে কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত শর্তাদিই কেবলমাত্র কার্যকর করতে আমরা আদিষ্ট। সুতরাং, আমি কোরআনের সুস্পষ্ট শর্ত বা নির্দেশনা ছাড়া শুধু শরিয়াবলে কোনো নাগরিককে শাস্তি দিতে পারি না। ’
এই শর্তগুলো বাস্তবায়নে তিনি ইসলামিক অনুশাসনের উৎসগুলোও (হাদিস, ফাতোয়া) পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান। তার এই আহ্ববান প্রচলিত ইসলামের সংস্কারে তার অভিলাষকেই প্রকাশ করে।
বিগত কয়েক বছর আগেও সৌদি সমাজে এই ধরনের বক্তব্যকে ঔদ্ধত্য হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। যার ফলে মোহাম্মদ আরকুন, মোহাম্মদ শাহরুর, ফরাজ ফুদা প্রমুখ উয়াহাবিজম বিরোধী সংস্কারবাদি মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের অনেককে নির্যাতন করা হয়েছিল, কারাবন্দী করা হয়েছিল।
সাক্ষাৎকারে এমবিএস বলেন, ‘শরিয়া আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারকে কোরআনের নির্দেশনাকেই প্রাধান্য দিতে হবে এবং মুতাওয়াতির হাদিসগুলোর (এমন হাদিস যার প্রতি স্তরে একাধিক বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত এবং সত্যতা প্রশ্নাতীত) আমল নিতে হবে। আহাদ-হাদিস (গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাকারী দ্বারা বর্ণিত কিন্তু বর্ণনাকারীর সংখ্যা মুতাওয়াতির হাদিসের সমান নয়) এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে এর সত্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা পরখ করা জরুরি আর ‘খবর’ হাদিসগুলোর (বর্ণনামূলক হাদিস যা নবী নির্দেশ করেননি কিন্তু বর্ণনাকারী নবীকে করতে দেখেছেন বা বলতে শুনেছেন) আমল একেবারেই করা উচিত নয়, যদি না এতে মানবতার কোনো কল্যাণ নিহিত থাকে। শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে নবীকে (স.) আনুসরণ করতে হবে, কোরআনের সরাসরি নির্দেশনা না থাকলে কাউকেই ধর্মীয় বিষয়ে শাস্তি দেওয়া যাবে না। ’
উপরোক্ত মানদণ্ডে হয়তো ১০ শতাংশ হাদিস পাওয়া যাবে যা কোরআনের সমকেন্দ্রিক। তাছাড়া পাথর মেরে হত্যা, চাবুক মারা, চুরি করলে হাত কাটা অথবা মুরতাদ এবং সমকামীদের হত্যা করার মতো আইনগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
ক্রাউন প্রিন্সের এমন আহ্বান আদর্শগত পরিবর্তনের নির্দেশক যা কিনা একটি পরিষ্কার দূরুত্ব তৈরি করবে উয়াহাবিদের সঙ্গে, যারা কোরআন-হাদিসের আক্ষরিক বা প্রত্যক্ষ অনুবাদেই বেশি বিশ্বাসী, তাদের সঙ্গে সহমত বা ভিন্নমত কোনোটা নিয়েই যাদের খুব বেশি মাথাব্যথা নেই।
তিনি আরও বলেন, কোরআন এবং মুতাওয়াতির হাদিসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকার পরও শুধু শরিয়ার অজুহাতে কাউকে শাস্তি প্রদান শরিয়তের অপপ্রয়োগই বটে। যখন আমরা কোনো দলের অন্তর্ভূক্ত হয়ে কোনো পণ্ডিত বা মনীষীর আনুসরণ করি, তখন আমরা তাকে দেবতুল্য করে ফেলি। যদিও আল্লাহ নিজের ও বান্দার মাঝে কোনো ব্যবচ্ছেদ রাখেননি। আল্লাহ নবী মুহম্মদের (স.) মাধ্যমে আমাদের কোরআনের শিক্ষা দিয়েছেন যার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সব যুগের জন্য উন্মুক্ত।
এমবিএস বলেন, শেখ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব যদি আজ আমাদের মাঝে উপস্থিত থাকতেন এবং দেখতেন তাকে দেবতুল্য করে শরিয়া বিষয়ে তার রচনাগুলোকে সমসাময়িক বিচার-বিশ্লেষণের ঊর্ধ্বে রেখে অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলেছি; তবে তিনিই হয়তো প্রথম ব্যক্তি হতেন যিনি এসবের প্রতিবাদ করতেন, এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন। আমাদের মাঝে কেউই চির-অভ্রান্ত দেবতুল্য নই আবার এখানে (ইসলাম চর্চায়) কোন স্কুল অব থটস বা ধারা নির্দিষ্ট করা নেই। কোরআন হাদিসের বর্ণনা-বিশ্লষণের ক্ষেত্রে সমসাময়িকতাকে সবসময় প্রাধান্য দেওয়া উচিত, ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও স্থান কাল এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর লক্ষ্য রাখা উচিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১০০ বছর আগে এমন কেউ যদি ফতোয়া দিয়ে থাকেন যিনি জানতেন না পৃথিবী গোল, মহাদেশ বা প্রযুক্তি নিয়ে যার কোনো ধারণা ছিল না তবে সেই ফতোয়া সেই সময়ের তথ্য- উপাথ্য নিয়ে কোরআন-হাদিসের সেই সময়ের বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই হয়ে থাকবে যদিও সময়ের সাথে বর্তমান বাস্তবতা ভিন্নতর।
মোহাম্মদ বিন সালমানের বক্তব্য থেকে মনে হয়, সৌদি শাসকরা কোরানিজম বা কোরানবাদকেই প্রাধান্য দিতে যাচ্ছেন। এটি একটি ধরণা যা হাদিসের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে এবং স্থান কাল ও সংস্কৃতির ভিন্নতায় এর বিশেষায়িত ব্যাখ্যার দাবি করে। কোরানবাদ এমন একটি ইসলামি মতবাদ যা দেশ ও সংস্কৃতির ভিন্নতায় ইসলামি অনুশাসনের প্রায়োগিক ভিন্নতাকে সমর্থন করে।
এই বৈপ্লবিক বক্তব্যের পরও এমবিএস সতর্কতার সঙ্গে এগোতে চান। তার বক্তব্য শুনে মনে হয়, তিনি মোহাম্মদ শাহরর, আহমেদ আবদো মাহের এবং অন্যান্য চিন্তাবিদদের বই পড়েছেন, যারা সম্ভবত তার পূর্বপুরুষ এবং আগের প্রজন্মের রক্ষণশীল ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য তাকে প্রভাবিত করেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন সৌদিদের বর্তমান ইসলাম উন্নয়ন এবং আধুনিকতা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রেখেছে।
এই ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, নিকট অতীতেও এই ধরনের বক্তব্যকে ওয়াহাবিরা ধর্ম বিদ্বেষী ফতোয়া দিতেন। যদিও মোহাম্মদ বিন সালমান এমন বক্তব্যে ওয়াহাবি নেতারা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখননি, উল্টো কেউ কেউ আবার তাকেই সমর্থন দিয়েছেন। তবে কি তারা ভয় পেয়ে গেলেন? কারণ এমবিএস বলেছিলেন, ‘কেউ যদি সন্ত্রাসী না হয়েও চরমপন্থা অবলম্বন করে, তবে সে অপরাধী এবং আইনে তার কঠোর শাস্তির বিধান করা হবে। ’
রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং শক্তি ছাড়া ইসলামের সংস্কার সম্ভব নয় যা আমি ২০১৭ এশিয়া নিউজেরই একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। তবে আজকের জন্য প্রধান জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, আর কোন কোন ইসলামিক দেশ সৌদিদের মতো সংস্কারের পথে হাঁটার সাহস দেখাবে?… নাকি তারা পুরনো ধ্যনধারণাতেই ডুবে থাকতে চায়। যারা এই সাহস দেখাতে পারবে না তাদেরকে আমার জন্মভূমি আলজেরিয়ার পরিণতি বরণ করতে হবে, যেখনে মুক্ত চিন্তার জন্যও জেলে যেতে হয়। কিছু মানবাধিকারকর্মী, যেমন সাইদ দাযাবেলখির (ইসলামোলজিস্ট) এবং ড. আমিরা বোরাউইনব যাদের নাম এখানে উল্লেখ করতেই হয় যারা শুধু নিজের মত প্রকাশের জন্য শাস্তি পেয়েছিলেন।
লেখক: কামেল আবদেররাহমানি
এশিয়া নিউজ অবলম্বনে ভাষান্তর: মিরকান মিশুক