২৩, ডিসেম্বর, ২০২৪, সোমবার
     

মাত্র ৯ সেকেন্ডেই ধুলায় মিশে গেল ভারতের টুইন টাওয়ার কিন্তু কেন!

কিছুক্ষণ আগেও ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের নয়ডার বুকে দাঁড়িয়েছিল দুটি বিশাল অট্টালিকা। কিন্তু ৯ সেকেণ্ডের কাউন্টডাউন শেষে চোখের পলকেই গুঁড়িয়ে গেল টুইন টাওয়ার। কুতুব মিনার বা স্ট্যাচু অব লিবার্টির থেকেও বেশি উচ্চতার এই টুইন টাওয়ার ভেঙ্গে ফেলার আগে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। জোড়া এই টাওয়ার ভাঙতে খরচ হয়েছে ২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ কোটি টাকা দেবে নির্মাণকারী সংস্থা, বাকি ১৫ কোটি টাকা ধ্বংসাবশেষ বিক্রি করে তোলা হবে বলে জানা গেছে। ১০০ মিটার উচ্চতার এই বিল্ডিং ভেঙে ফেলা হলেও এখানেই শেষ হয়নি কাজ। দুটি সুউচ্চ টাওয়ারের জায়গায় এখন রয়েছে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। এরপর তিনমাস ধরে চলবে এই ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ। এর জন্য ১ হাজারেরও বেশি ট্রাক মোতায়েন করা হবে।

কী কী প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল?
রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে নয়ডার সেক্টর ৯৩-এ’র টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলা হলো। বেআইনি নির্মাণের কারণেই ৪০ তলা (আনন্দবাজার বলছে ও এনডিটিভি বলছে, ৩২ তলা) উচ্চতার বিল্ডিংটি ভেঙে ফেলা হল। দেশে এর আগে এত বড় বিল্ডিং ভাঙার কর্মযজ্ঞ দেখা যায়নি কখনো। বছর দুয়েকে আগে কেরালায় একইভাবে একটি বহুতল ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সেই সংস্থাই নয়ডার টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলার কাজ করেছে। গোটা কর্মযজ্ঞে তদারকি করতে দিল্লি পুলিশের বিশাল বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। উপস্থিত ছিল বম্ব স্কোয়াডও। বিপদ এড়াতে আশপাশের হাসপাতালে ৪০টি বেড অগ্রিম বুকিং করেই রাখা হয়েছিল। ৩৭০০ কেজি বিস্ফোরক দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে এই বেআইনি নির্মাণটি। বিস্ফোরণের ব্যপকতার কথা মাথা রেখে আগে থেকেই আশেপাশের এলাকা ফাঁকা করে দেয়া হয়েছিল। ধ্বংসের আগে প্রায় ৭ হাজার বাসিন্দাদের স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। আড়াই হাজারেরও বেশি গাড়ি ওই এলাকার বাইরে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কোনো দুর্ঘটনা এড়াতে আগে থাকতেই এলাকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। বিকেল ৪টায় আবার এই সংযোগ চালু করা হবে বলে জানা গেছে। সাড়ে ৫টা থেকে বাসিন্দাদের নিজেদের বাড়িতে ফিরতে দেয়া হবে।

কতটা ভয়ঙ্কর ছিল বিস্ফোরণ?
টুইন টাওয়ার ধ্বংসের কাজের সাথে যারা যুক্ত, তারা জানিয়েছিলেন, ১০০ মিটার উচ্চতার এই টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলার জন্য ৩৭০০ কেজির বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে। আগেই বিল্ডিংয়ের ভেতরে ইমারতগুলি ভাঙা হয়েছে। এরপর পিলারগুলোর ভেতরে প্রায় ৭ হাজার গর্ত করে তাতে বিস্ফোরক গুঁজে দেয়া হয়েছে। এক ট্রিগারের চাপেই গুঁড়িয়ে ফেলা হলো টুইন টাওয়ারটি। ২০ হাজার সার্কিট বসানো হয়েছিল, ওয়াটারফল টেকনিকেই বিল্ডিংগুলি ভেঙে ফেলা হয়েছে। আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল, বিস্ফোরণের পর ৩০ মিটার অঞ্চলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য কম্পন হতে পারে, যা হালকা ভূমিকম্পের মতোই অনুভূত হবে। এক পলকেই টুইন টাওয়ার ভেঙে পড়ার পরই ধুলোয় ঢেকে যায় এলাকা। এই বিষয়েও আগে থাকতেই আন্দাজ করা গিয়েছিল যে, বিশাল ধূলিঝড় উঠতে পারে। সেই আশঙ্কায় আশেপাশের বাড়িগুলিকে প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছিল। বিস্ফোরণের সময়ে গ্রেটার নয়ডা এক্সপ্রেসওয়েতেও কিছুক্ষণের জন্য যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল। ৪৫০ মিটারকে নো-গো-জ়োন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। দুপুর ২ টা ১৫ মিনিট থেকে ২.৪৫ মিনিট পর্যন্ত বন্ধ ছিল যান চলাচল। এছাড়া সেক্টর ৯৩-এর আশেপাশের বেশ কিছু রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয় সেই সময়।

তিনমাস ধরে চলবে সাফাই অভিযান
বিস্ফোরণের পর ধূলোয় ঢেকে গিয়েছিল গোটা এলাকা। কিছুক্ষণের জন্য কোনো কিছুই দৃশ্যমান ছিল না। তারপর ধূলিঝড় কমতেই টুইন টাওয়ারের জায়গায় শূন্যস্থান চোখে পড়ে। প্রায় ৫৫ হাজার টন ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয়েছে। এখন নয়ডা কর্তৃপক্ষের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ৫৫ হাজার টন ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করা। এর জন্য কমপক্ষে প্রায় তিনমাস সময় লাগবে বলে জানা গেছে। এর জন্য প্রায় ১ হাজার ট্রাক মোতায়েন করা হবে। একটি নির্দিষ্ট জায়গাও বাছাই হয়েছে এই ধ্বংসাবশেষগুলি ফেলার জন্য। ওই ধ্বংসস্তূপ বিক্রি করে ১৫ কোটি টাকা আয় করা হবে।

কত টাকার বিমা রয়েছে?
এই টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জন্য ১০০ কোটির বিমা করানো হয়েছে। এতে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের কারণে আশেপাশের যে বাড়িগুলির কোনো ক্ষতি হলে, তার ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। শুধুমাত্র টুইন টাওয়ার ভাঙতেই ২০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। যদি কোনো অতিরিক্ত ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকলে, নির্মাণকারী সংস্থা সুপারটেক লিমিটেডকে সেই ক্ষতির খরচ বহন করতে হবে। বিল্ডিংয়ের কাঠামো ভাঙতে ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

কেন ভেঙে ফেলা হলো এই টুইন টাওয়ার?
২০০৫ সালে নয়ডার সুপারটেক লিমিটেড এই টুইন টাওয়ার তৈরির কাজ শুরু করে। প্রকল্পের নাম দেয়া হয় এমেরাল্ড কোর্ট। নয়ডা ও গ্রেটার নয়ডার মাঝে এই টুইন টাওয়ারে ৩, ৪ ও ৫ বিএইচকে ফ্ল্যাট তৈরি করা হবে বলে জানানো হয়েছিল। এক একটি ফ্ল্যাটের দামই ১ থেকে ৩ কোটি টাকা ছিল। ২০০৫ সালে ১৪টি বিল্ডিং তৈরি করা হবে বলেছিল। প্রত্যেকটি বিল্ডিংয়ে ৯টি তলা থাকত। কিন্তু ২০১২ সালে হঠাৎ সেই পরিকল্পনা বদলে ফেলা হয়। এমারেল্ড কোর্টে ১৫টি বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেকটি বিল্ডিংয়ে ১১টি তলা ছিল। দুটি টাওয়ার ৪০ তলা অবধি তৈরি করা হয়। নয়ডা কর্তৃপক্ষ নতুন পরিকল্পনাটিকে অনুমোদন দিয়েছিল।

কিন্তু, এরপরই বাড়ির ক্রেতারা এই দুই টাওয়ার তৈরির বিরোধিতা করেন। তারা দাবি করেন, টাওয়ারগুলো নিয়ম ভেঙে একে অপরের গায়ে লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে। দুটি বহুতলের মধ্যে ন্যূনতম যে দূরত্ব রাখতে হয়, তা মানা হয়নি। ফ্ল্যাট মালিকদের অনুমতিও নেয়া হয়নি টাওয়ারের উচ্চতা বাড়ানো ও অবস্থান বদল নিয়ে সম্মতিও নেয়া হয়নি। এরপরই সিয়ান ও অ্যাপেক্স নামক এই টুইন টাওয়ারকে ভেঙে ফেলার দাবি জানানো হয়। নয়ডা কর্তৃপক্ষ বিল্ডিং ভেঙে ফেলতে রাজি না হওয়ায় প্রথমে এলাহাবাদ হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। ২০১৪ সালে হাইকোর্ট এই টাওয়ার ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়। এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে নির্মাণকারী সংস্থা সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানালেও ২০২১ সালে শীর্ষ আদালতের তরফেও এই টাওয়ারকে ভেঙে ফেলার কথা বলা হয়। সেই নির্দেশ মেনেই আজ টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলা হল।

               

সর্বশেষ নিউজ