২২, ডিসেম্বর, ২০২৪, রোববার
     

কৃষকের ভর্তুকি দরকার

প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও সিঙ্গাপুরিয়ানরা দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে। সব নাগরিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছে। ওদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলার, আর এটা সম্ভব হয়েছে ওদের যোগ্য নেতৃত্বের গুণ, দুর্নীতিমুক্ত দক্ষ সিভিল সার্ভিস ও কলুষতাহীন রাজনীতির কল্যাণে।

অথচ আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ও এত বড় জনবল থাকিতেও আমরা তাদের সাথে পেরে উঠছিনা যোগ্য নেতৃত্ব ও দুর্নীতি আমাদের পেছনের দিকে টেনে ধরছে । একটি দেশের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য অন্যতম, যা মানুষের জন্মগত অধিকারও বটে। ক্ষুধার বিরুদ্ধে সব থেকে ভালো ভ্যাকসিন খাবার।

একটি সুস্থ জীবনের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস প্রয়োজন। আর খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশ নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাকে সামনে রেখে তা বাস্তবায়নের কাজ করে। তবে খাদ্যের সঙ্গে কৃষির সম্পর্কটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যদি কৃষিকে বাদ রেখে আমরা খাদ্যের কথা বলি তবে বিষয়টি হবে অযৌক্তিকও হাস্যকর। খাদ্য উৎপাদনে কৃষক প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে । দেশের বৃহৎ জনসংখ্যার প্রধান পেশা কৃষি।

বাংলাদেশকে খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করতে প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনতে ও খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষিতে ভর্তুকি না দিয়ে কৃষককে ভর্তুকি দিলে অল্প খরচে বেশী উৎপাদন সম্ভব। কারণ কৃষিতে ভর্তুকি দিলে লাভবান হয় সার, কীটনাশক, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো, আর কৃষককে ভর্তুকি দিলে লাভবান হবে কৃষক এতে বাঁচবে কৃষক,বাঁচবে দেশ। বাড়বে উৎপাদন । আমাদের দেশে কৃষককে ভর্তুকি না দিয়ে কৃষিতে ভর্তুকি দিচ্ছে। রাষ্ট্র যত বেশি কৃষিপণ্য যেমন: ধান, গম, ভুট্টা ও সবজি ইত্যাদি উৎপাদনে কৃষককে সরাসরি ভর্তুকি প্রদান করবে খাদ্য উৎপাদনও ততবেশি বৃদ্ধি পাবে।

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষককে ভর্তুকি প্রদান করলে, তখন কৃষক কম মূল্যে বেশি খাদ্য উৎপাদনে সক্ষম হবে এবং জনগণের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারবে,যা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে।

বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশের জন্য এসডিজির অর্জনে কৃষি খাতে উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই, দারিদ্র বিমোচন এবং সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষকের অবদান অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই সব ধরনের বৈষম্য ও খাদ্যসংকট ঝুঁকি দূর করতে এখনই কৃষককে ভর্তুকি প্রদান করা দরকার।

তথাকথিত উন্নয়নের নামে কিছু লোক সম্পদশালী হচ্ছে এবং হয়তো আরো সম্পদশালী হবে। বাংলাদেশে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল কৃষক-শ্রমিকের, যা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেই কৃষক-শ্রমিক, বেকার-হকারদের প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন হয়নি।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে-এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ কিন্তু বাস্তবে কি তা হচ্ছে ? দ্রব্যমূল্যের দাম পাগলা ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। তার বাস্তবিক প্রমাণ হলো ২০২০ সালে এজন্য কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে জমিনের পাকা ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন।

ধান কাটা শ্রমিকদের আকাশচুম্বী মজুরির কারণে বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন এলাকায় কৃষক। প্রতিদিন একজন শ্রমিককে ১ হাজার ৪০০ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি তিন বেলা খাবার দিতে হয়। অনেক জায়গায় শ্রমিকরা প্রতি একর জমির ধান কাটতে ২০-২৫ হাজার টাকায় চুক্তি করছেন। শ্রমিকরা উচ্চ মজুরি হাঁকানোয় কারণে নিরীহ কৃষকের কণ্ঠে বেশি অসহায়ত্ব ধরা পড়ে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নেওয়ার পরে গত ১৩ বছরে কৃষিতে সরকার ৯৭ হাজার ৮৭৩ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা ভর্তুকি দিয়েছে বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক। এর মধ্যে সারে ভর্তুকির ছিল ৯৫ হাজার ১৬১ কোটি ৫ লাখ এবং বিদ্যুতে এক হাজার ৯৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকির জন্য ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫,৩৭৪ কোটি টাকা । যা গত বছরের তুলনায় ১,৬৭৬ কোটি টাকা বেশি। বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বেড়েছে কিন্ত অবস্থার কি কোন পরিবর্তন হয়েছে? কৃষিখাতে বরাদ্দ বাড়িলে যে কৃষক লাভবান হয়েছে এমনটি কিন্ত নয় ।

কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি শিরোনামে যে অনুচ্ছেদটি রয়েছে, তার মধ্যে চারটি কার্যক্রম আছে যা সরাসরি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করবে, কৃষকের নয়। ১. কৃষকদের সাশ্রয়ী মূল্যে সার সরবরাহে ভর্তুকি; ২. সেচ কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলের ২০ শতাংশ রেয়াত; ৩. কৃষি যান্ত্রিকীকরণের হাওড় ও উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ ও অন্যান্য এলাকায় ৫০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তায় ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষি যন্ত্র সরবরাহের কার্যক্রম; ৪. বোরো মৌসুমে দীর্ঘ জীবনকালীন ধানের পরিবর্তে স্বল্প জীবনকালীন ধানের আবাদ।

বাজেটে সার-কীটনাশকের ভর্তুকি দেয়ার রেওয়াজ রয়েছে এবং আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও বাজেটে যখন কৃষকদের জন্য বরাদ্দ দাবী করে, তখন সার-কীটনাশকের কথা বলেন। এই প্রশ্ন তোলা হয় না, যে এই ভর্তুকি কি কৃষক পায় নাকি সার-কীটনাশকের ব্যবসায়ীরা পায়? কৃষক সাশ্রয়ী মূল্যে যা পাচ্ছে, সেই ভর্তুকি ব্যবসায়ীদেরকেই দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, ব্যবসায়ীদের ব্যবসার কোন ক্ষতি হচ্ছে না । অথচ ব্যবসায়ী কিন্তু তার ইচ্ছেমতো সারের দাম কম-বেশি করলেও দেখার কেউ নেই। বিগত কয়েক অর্থবছরের বাজেটে সারের ওপর ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে।

সেচ কাজে বিদ্যুতের রেয়াত কে পাচ্ছে? নিশ্চয়ই কৃষক নয়। কৃষকদের স্থানীয় বীজ, কৃষকের জ্ঞান, ফসলের ন্যায্য মূল্য ও সুস্থ পরিবেশের নিশ্চয়তা দিলে– এ দেশের মানুষের খাদ্য জোগান দিতে পারবে। কৃষকদের ভর্তুকি না দেয়ার ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় এবং কৃষকদের লগ্নি করে ফসল উঠাতে হয় । ফসল ঘরে ঊঠতে না উঠতেই লগ্নির টাকার জন্য ফসল কম দামে বিক্রি করতে হয় ফলে ফসল চলে যায় মজুদদারদের হাতে । তারা জনগণকে জিম্মি করে পন্য কিনতে বাধ্য করে। ফলে কৃষকের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন আসে না ।

সরকার কৃষকের পাশে দাঁড়ালে, কৃষকরাই খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ দেশ উপহার দিবে, কোম্পানী নয়।

মোহাম্মদ মোক্তার হোসেন
সম্পাদক
crimevision.news

               

সর্বশেষ নিউজ