ইসরাইল-ফিলিস্তিনি সংঘাতে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অনেকে। এই দুই সম্প্রদায়ের সংঘাতের বীজ বোনা হয়েছিল এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে পরিচালিত একটি ঔপনিবেশিক কর্মে।
বেলফোর ঘোষণা কী
১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব আর্থার বেলফোর ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন সদস্য লিওনেল ওয়াল্টার রথচাইল্ডকে সম্বোধন করে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটি ছিল মাত্র ৬৭ শব্দের। কিন্তু এর তাৎপর্য এত বেশি তা এখনো ধারণ করতে হচ্ছে পৃথিবীকে।
এই চিঠিতে ব্রিটিশ সরকারকে ‘ইহুদি জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় বাসস্থান প্রতিষ্ঠা’ ও তার ‘অর্জন’ সহজতর করার কথা উল্লেখ ছিল। আর এই চিঠিটিই বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। সেসময় ফিলিস্তিনে আরব স্থানীয় জনসংখ্যা ছিল ৯০ শতাংশেরও বেশি।
ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে একটি ব্রিটিশ আদেশপত্র অথবা ম্যান্ডেট ১৯২৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল। স্থায়ী হয়েছিল ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। এ সময় ইহুদি অভিবাসনকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছিল ব্রিটিশরা। ইউরোপে নাৎসিবাদের অত্যাচার থেকে পালাতেও অনেকে ফিলিস্তিনে আশ্রয় নিয়েছিল।
১৯৩০-এর দশকে যা ঘটেছিল
ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা আরব বিদ্রোহের সূচনা করেছিল। স্থায়ী হয়েছিল ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত। ১৯৩৬ সালের এপ্রিলে নবগঠিত আরব জাতীয় কমিটি ফিলিস্তিনিদের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও ক্রমবর্ধমান ইহুদি অভিবাসনের প্রতিবাদে ট্যাক্স প্রদান বন্ধ ও ইহুদি পণ্য বয়কটের মাধ্যমে একটি সাধারণ ধর্মঘট শুরু করার আহ্বান জানায়।
এ ধরনের ধর্মঘট ছয় মাস স্থায়ী হয়েছিল। তবে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিল ব্রিটিশদের দ্বারা। গণগ্রেফতার অভিযান থেকে শুরু করে বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছিল।
বিদ্রোহের দ্বিতীয়পর্ব শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালের শেষের দিকে। ব্রিটিশ বাহিনী ও উপনিবেশবাদকে লক্ষ্য করে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ফিলিস্তিনি কৃষক। ১৯৩৯ সালের দ্বিতীয়র্ধে ব্রিটেন ফিলিস্তিনে ৩০ হাজার সৈন্য সংগ্রহ করেছিল। সে সময় ফিলিস্তিনের গ্রামগুলোতে বিমান বোমাবর্ষণ, কারফিউ জারি করা, বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া অব্যাহত ছিল।
ব্রিটিশরা ইহুদি বসতি স্থাপনকারী সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতা করে সশস্ত্র দলও গঠন করেছিল সে সময়। ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন ইহুদি যোদ্ধাদের নিয়ে একটি ‘বিদ্রোহ দমন বাহিনী’ গঠন করেছিল যার নাম ছিল স্পেশাল নাইট স্কোয়াড।
বিদ্রোহের সেই তিন বছরের মধ্যে পাঁচ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। আহতের সংখ্যা ছিল ১৫ থেকে ২০ হাজার। বন্দি করা হয়েছিল পাঁচ হাজার ৬০০ ফিলিস্তিনিকে।
জাতিসংঘের বিভাজনের পরিকল্পনা কী ছিল?
১৯৪৭ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা ৩৩ শতাংসে পৌঁছে। সে সময় তারা ৬ শতাংশ জমির মালিক ছিল। ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্রে বিভক্ত করতে জাতিসংঘে ১৮১ প্রস্তাব গৃহীত হয়।
ফিলিস্তিনিরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল সে সময়। কারণ প্রস্তাবটিতে ফিলিস্তিনের প্রায় ৫৬ শতাংস ইহুদিদের জন্য বরাদ্দ ছিল। যার মধ্যে বেশির ভাগ উর্বর উপকূলীয় অঞ্চলও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে সময় দেশটির ৯৪ শতাংশের মালিক ছিল ফিলিস্তিনিরা। আর জনসংখ্যা ছিল ৬৭ শতাংশ।
১৯৪৮ সালের নাকবা অথবা ফিলিস্তিনের জাতিগত নির্মূল
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অথবা আদেশপত্র শেষ হওয়ার আগেই ইহুদি রাষ্ট্রের সম্প্রসারণে ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রাম ধ্বংস করতে একটি সামরিক অভিযান শুরু করেছিল। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে জেরুজালেমের উপকণ্ঠে দেইর ইয়াসিন গ্রামে ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল।
১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ৫০০টিরও বেশি ফিলিস্তিনি গ্রাম শহর ধ্বংস করা হয়েছিল। যাকে ফিলিস্তিনিরা আরবি ভাষায় ‘নাকবা অথবা বিপর্যয়’ হিসাবে উল্লেখ করে। গণহত্যায় কমপক্ষে ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন।
ইহুদিরা সে সময় ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ দখল করেছিল। আর অবশিষ্ট ২২ শতাংশ বর্তমানে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা।
১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পরই শুরু হয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে ইসরাইল, মিসর, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তা শেষ হয়।
নাকসা অথবা ছয় দিনের যুদ্ধ
১৯৬৭ সালের ৫ জুন আরব সেনাবাহিনীর একটি জোটের বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, সিরিয়ার গোলান হাইটস ও মিসরের সিনাই উপদ্বীপসহ ফিলিস্তিনের বাকি অংশ দখল করে। এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য দ্বিতীয় জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি বা নাকসা নামে পরিচিত। আর এর আরবি অর্থ ‘বিপর্যয়’। সে সময় অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায়ও বসতি স্থাপন শুরু করেছিল ইহুদিরা।
প্রথম ইন্তিফাদা ১৯৮৭-১৯৯৩
১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে গাজা উপত্যকায় প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা শুরু হয়। সে সময় ইসরাইলের একটি ট্রাক ফিলিস্তিনি শ্রমিক বহনকারী দুটি ভ্যানের সঙ্গে সংঘর্ষে চার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল।
তরুণ ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের সেনাবাহিনীর ট্যাংক ও সৈন্যদের দিকে ঢিল ছুড়লে দ্রুত পশ্চিম তীরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ইন্তিফাদা প্রাথমিকভাবে তরুণদের দ্বারা পরিচালনা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই বিদ্রোহে অংশ নেয় ইউনিফাইড ন্যাশনাল লিডারশিপ।
১৯৮৮ সালে আরব লীগ প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে (পিএলও) ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ইন্তিফাদা কার্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে জনপ্রিয় সংহতি, গণবিক্ষোভ, আইন অমান্য, সুসংগঠিত ধর্মঘট ও সাম্প্রদায়িক সহযোগিতা।
ইসরাইলের মানবাধিকার সংস্থা বি’তেসেলেমের মতে, ইন্তিফাদার সময় ইসরাইলের বাহিনীর হাতে এক হাজার ৭০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ছিল ২৩৭ জন। গ্রেফতার করা হয়েছিল এক লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে।
অসলো বছর
১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষর ও প্যালেস্টাইন অথরিটি (পিএ) গঠনের মাধ্যমে শেষ হয় ইন্তিফাদা। পিএ চুক্তি ইসরাইলকে পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ ও ভ‚খণ্ডের ভ‚মি ও পানি সম্পদের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা ২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছিল। সে সময় লিকুদ বিরোধী নেতা এরিয়েল শ্যারন জেরুজালেমের পুরাতন শহর ও তার আশপাশে হাজার হাজার নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে সফর করেছিলেন।
ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘর্ষে দুদিনে পাঁচজন ফিলিস্তিনি নিহত ২০০ জন আহত হয়েছিল। ঘটনাটি একটি ব্যাপক বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছিল। ইন্তিফাদার সময় ইসরাইল ফিলিস্তিনি অর্থনীতি ও অবকাঠামোর নজিরবিহীন ক্ষতি করেছে।
ফিলিস্তিন বিভাগ ও গাজা অবরোধ
পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত ২০০৪ সালে মারা যান। তার এক বছর পর দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শেষ হয়। ফিলিস্তিনিরা প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেয় সে সময়। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় হামাস। ২০০৭ সালের জুনে হামাসের ওপর ‘সন্ত্রাসবাদের’ অভিযোগ এনে গাজা উপত্যকায় স্থল, বিমান ও নৌ অবরোধ আরোপ করে ইসরাইল।
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ
গাজায় ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২১ সালে চারটি দীর্ঘস্থায়ী সামরিক হামলা করেছে ইসরাইল। হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত ও কয়েক হাজার বাড়ি, স্কুল ও অফিস ভবন ধ্বংস হয়েছে।
আলজাজিরা