ক্রাইমভিশন ডেস্ক:
সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তবে নির্বাচনের সময়টাতে নির্বাচনকালীন সরকারের আবহ আনতে মন্ত্রিসভায় রদবদল করতে চাচ্ছে ক্ষমতাসীন দরকার। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে ওই সরকার গঠন করতে চাচ্ছে তারা। এক্ষেত্রে ২০১৩ সালের আদলে ‘সর্বদলীয় সরকার’ গঠনের চিন্তাভাবনা রয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের। সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্রসহ দেশের নিবন্ধিত সব দলই শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে ওই সময় সরকারের রূপে খুব একটা পরিবর্তন আনার প্রয়োজন পড়েনি। তবে, বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশ ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করায় ওই সময় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী প্রায় সব দলকে নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হয়েছিল।
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও বড় একটি অংশের বয়কটের আশঙ্কা থাকায় ২০১৩ সালের মতো সর্বদলীয় সরকারের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। তফসিল ঘোষণার আগ দিয়ে এই সরকার গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, তফসিল ঘোষণার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্ত্রিসভায় রদবদল হোক বা না হোক, কিংবা সরকারি দলের বাইরে থেকে কাউকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হোন না কেন, তাতে সরকার ব্যবস্থায় কোনও হেরফের হবে না। অন্যান্য দলের প্রতিনিধি যুক্ত হলেও সেটা হবে বর্তমান সরকারেরই ধারাবাহিকতা।
সংবিধানে নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তীকালীন, কিংবা সর্বদলীয় সরকারের কোনও বিধান না থাকায় নির্বাচনের সময় সরকারের আবহে কিছুটা পরিবর্তন মনে হলেও তা হবে বিদ্যমানের মতো স্বাভাবিক সরকারই। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ওই সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনকে সার্বিকভাবে সহায়তা করবে। সরকারে কোনও পরিবর্তন না আনা হলেও এই সহায়তার ক্ষেত্রে কোনও ভিন্ন ম্যাটার করবে না।
সংবিধানের বিধান অনুসারে, বিদ্যমান সরকার ক্ষমতায় থাকতেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হলেও সরকারের ওপর তার প্রভাব পড়বে না। সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকতে এই অনুচ্ছেদের কোনোকিছুই অযোগ্য করবে না।’
জানা গেছে, নির্বাচনকালীন একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী একাধিক শরিক দলের নেতাকে ওই মন্ত্রিসভায় থাকার জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়াও সংসদে বর্তমানে জাতীয় পার্টি (প্রধান বিরোধী দল), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি (জেপি), তরিকত ফেডারেশন, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ এবং গণফোরামের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।
এর মধ্যে জাতীয় পার্টি নির্বাচন ইস্যুতে কিছুটা বিভক্তির মধ্যে রয়েছে। বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তারা সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন। অবশ্য পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরসহ দলটির বৃহৎ অংশ এখনও পর্যন্ত তাদের অবস্থান খোলাসা করেনি। এই অংশটি বলছে, তারা কারও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হবে না। এদিকে গণফোরামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়ার বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত না হলেও নির্বাচনকালীন সরকারে যাবে না, এমন অবস্থানে রয়েছে দলটি। তবে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের প্রায় সবাই সরকারের সঙ্গে থাকতে চায় বলে জানা গেছে।
২০১৩ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়কালের সরকারের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে সরকারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। ওই সময় তফসিল ঘোষণার কয়েকদিন আগে ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর সরকারের মন্ত্রিসভার সব সদস্যই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন। ১৮ নভেম্বর শপথ নিয়েছিলেন মন্ত্রিসভার নতুন ৬ মন্ত্রী ও দুই প্রতিমন্ত্রী।
নতুন মন্ত্রিদের মধ্যে দুই জন ছিলেন আওয়ামী লীগের, একজন ওয়াকার্স পার্টির এবং তিন জন জাতীয় পার্টির। এছাড়া দুই প্রতিমন্ত্রীর দুজনই ছিলেন জাতীয় পার্টির। ওই সময় পুরনো ৫১ সদস্যের মন্ত্রিসভার মধ্যে টেকনোক্র্যাট কোটার তিন জন মন্ত্রীসহ ১৬ জন মন্ত্রী ও ১৪ জন প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে বাকিদের মন্ত্রিসভায় বহাল রাখা হয়। ফলে নতুন শপথ নেওয়া সদস্য মিলে নির্বাচনকালে মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন ২৯ জন।
মন্ত্রিসভার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পদেও সংযোজন-বিয়োজন হয়েছিল। ওই সময়কার প্রধানমন্ত্রীর সাত উপদেষ্টার মধ্যে পাঁচ জন পদত্যাগ করেন। পাশাপাশি টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, জাতীয় পার্টির (জাপা) জিয়াউদ্দিন আহমেদকে উপদেষ্টা করা হয়।
২০১৩ সালে নির্বাচনের সময় সরকারে বড় পরিবর্তন আনা হলেও সেই তুলনায় ২০১৮ সালে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। ওই সময় কেবল টেকনোক্র্যাট কোটার মন্ত্রী মতিউর রহমান, নুরুল ইসলাম বিএসসি, ইয়াফেস ওসমান ও মোস্তাফা জব্বার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদত্যাগ করেছিলেন।
জানা গেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার ২০১৩ সালের মতো মন্ত্রিসভায় বড় পরিবর্তন আনার চিন্তা করছে সরকার। এক্ষেত্রে টেকনোক্র্যাট কোটার মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, মোস্তাফা জব্বার ও প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমসহ বর্তমান মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য পদত্যাগ করতে পারেন।
পাশাপাশি ক্ষমতাসীন ও শরিক দলের একাধিক এমপিকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার আকার বর্তমানের চেয়ে ছোট হতে পারে বলে জানা গেছে। তফসিল ঘোষণার কিছুটা আগে এই পরিবর্তন আসতে পারে। উল্লেখ্য, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সরকারের রদবদল হয়েছিল।
তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রবিবার (১৫ অক্টোবর) তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গতবার যেভাবে ছিল ওটাই নির্বাচনকালীন সরকার। এটা শেখ হাসিনার এখতিয়ার। তিনি যদি মনে করেন, মন্ত্রিসভা ছোট করার দরকার বা যেভাবে আছে সেভাবে থাকা দরকার, এটা তার এখতিয়ার। এখনই এই আলাপ করার সময় না।’
তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন খুব শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হয়ে যাবে জানিয়ে কাদের বলেন, ‘তখন কোনও উদ্বোধন আমরা করতে পারবো না। সরকারের কোনও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরুও করতে পারবো না। তখন আমরা জাস্ট রুটিন ওয়ার্ক করবো।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সময়ে বর্তমান মন্ত্রিসভার পুরোটা থাকবে কিনা, নাকি সেটি ছোট করবেন কিংবা বড় করবেন— সেটি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। নির্বাচনের সময়ে বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে বা হতে যাচ্ছে, এ কথাগুলো আসলে সংবিধান সম্মত নয়। সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।’
তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, ‘আমরা সরকারের জোটে আছি। সরকারের তরফ থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের কোনও প্রস্তাব আসলে আমাদের না যাওয়ার কোনও কারণ নেই। যেসব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে, তা মোকাবিলায় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে একসঙ্গে নিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা উচিত বলে আমি মনে করি। আর ওই ধরনের কোনও সরকারে আমার দলকে আমন্ত্রণ জানালে আমরা তার সঙ্গে থাকবো।’
জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার বলেন, ‘মন্ত্রিসভার অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি একান্ত প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনি যেভাবে চাইবেন সেভাবেই হবে। আমাদের সঙ্গে এখনও এ ধরনের কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি। এ ধরনের কোনও প্রস্তাব এলে তখন বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
চলতি একাদশ সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হবে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। আগামী ১ নভেম্বর থেকে এই ৯০ দিন গণনা শুরু হবে। নির্বাচন কমিশন ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোটগ্রহণের দিন ঠিক করে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে।