নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে দেশে প্রথমবারের মতো ভূগর্ভস্থ গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। এজন্য ২০১৮ সালে নেওয়া হয়েছিল ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প। এই টাকায় ২০২৩ সালের মধ্যে রাজধানীর গুলশান ও কারওয়ান বাজারে মাটির নিচে দুটি গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণের কথা ছিল। সেই মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্পের ডিজাইন ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি ডেসকো ও ডিপিডিসি। এরই মধ্যে ১৩০ কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কাজ শুরুর আগে প্রকল্প দুটি আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, প্রাক্কলন অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় অত্যধিক বেশি হওয়ায় অনুমোদিত কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্প সমাপ্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্প সমাপ্তির বিষয়ে গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগ, ডিপিডিসি-ডেসকো, পরিকল্পনা কমিশন, ইআরডি ও আইএমইডির সমন্বয়ে বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সার্বিক বিষয় বিবেচনা ও বাস্তবতার নিরিখে অনুমোদিত কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্প সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় ভূগর্ভস্থ উপকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প সমাপ্ত করার জন্য ডিপিডিসি ও ডেসকোকে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ অনুযায়ী, প্রকল্প দুটির কাজ অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে ডেসকো ও ডিপিডিসি। তবে কাজ অসমাপ্ত রেখে চুক্তি সমাপ্ত করা, চুক্তি অনুযায়ী সম্পাদিত কাজের বিপরীতে বিল পরিশোধসহ সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াগুলো শেষ করাসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনায় প্রকল্পের মেয়াদ ছয় মাস বৃদ্ধির আবেদন করা হয়েছে।
দুটি প্রকল্পের মধ্যে ডেসকোর ‘ঢাকাস্থ গুলশানে ১৩২/৩৩/১১ কেভি ভূগর্ভস্থ গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণ’ প্রকল্পটি ২০১৮ সালে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। খরচ ধরা হয় ৯৫০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পটির আওতায় এখন পর্যন্ত ৭১ কোটি ৯০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত নভেম্বর পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি অনুমোদিত ব্যয়ের ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ।
ডিপিডিসির আওতায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে ভূগর্ভস্থ উপকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পটিও ২০১৮ সালে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। ৯৫০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হয়। কাজ না হলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় ৫৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের আর্থিক ৬ দশমিক ১২ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
জাইকার ঋণে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে অবকাঠামো নির্মাণ, দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ, ভূগর্ভস্থ উপকেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উপকেন্দ্রের ওপর বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা। প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে ছিল ৯০ ফুট মাটির নিচে ভূগর্ভস্থ গ্রিড উপকেন্দ্র এবং মাটির ওপরে ৩৫ তলা টাওয়ার ভবন নির্মাণ করা।
ভূগর্ভস্থ গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণ ছাড়াই প্রকল্প সমাপ্তির কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প দুটির প্রকল্প পরিচালকরা প্রায় একই কথা বলেন। প্রকল্প বন্ধের বিষয়ে তারা বলেন, উপকেন্দ্র দুটি নির্মাণের জন্য যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল, প্রকল্প বাস্তবায়নে তার চেয়েও অত্যধিক বেশি অর্থ খরচ হবে। এজন্য কাজ অসমাপ্ত রেখেই প্রকল্প সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গুলশান ১৩২/৩৩/১১ কেভি ভূগর্ভস্থ গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘এটি একটি আইকনিক প্রজেক্ট ছিল। এটি নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশকে একটি উচ্চমাত্রায় নিয়ে যেত। কিন্তু প্রকল্পে অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে বাস্তবায়ন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি এবং ডলার রেট বেড়ে যাওয়ায় অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্বিগুণ অর্থ চাচ্ছেন দরপত্রে অংশ নেওয়া ঠিকাদাররা। বুয়েট এ প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করেছিল, তারাও বলেছে ব্যয় বেশি হয়ে যাচ্ছে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এত বেশি টাকা দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা ঠিক হবে না বলে প্রকল্পটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তাতে পরিকল্পনা কমিশন ও আইএমইডি সম্মতি জানিয়েছে।’
নির্মাণকাজ না হলেও প্রায় ৭২ কোটি টাকা অপচয় হলো কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এত দিন ধরে কাজ করার পরও নির্মাণ না করেই খরচ করা হয়েছে, এই সেন্সে অপচয় বলা যেতে পারে। তবে এই টাকা দেশি-বিদেশি পরামর্শক ও আমাদের বেতন-ভাতায় খরচ হয়েছে। পরামর্শকরা ডিজাইনের কাজ করেছেন। এখন না হলেও ভবিষ্যতে সাব-স্টেশন নির্মাণ করা লাগবে, তখন এই ডিজাইন কাজে লাগবে।’
কারওয়ান বাজারে ভূগর্ভস্থ উপকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ফজিলাতুন নেসা কালবেলাকে বলেন, ‘প্রজেক্টের উদ্দেশ্য অর্জনের তুলনায় খরচ বেশি হচ্ছে, এ কারণেই মূলত এটা বাতিল করা হচ্ছে।’
প্রকল্প নেওয়ার সময় কেন এটা জানা যায়নি—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের প্রজেক্ট এর আগে বাংলাদেশে কখনো হয়নি। এটার ব্যয় নির্ধারণ আমরা করিনি। ব্যয় নির্ধারণ করেছিলেন জাপানের পরামর্শকরা। তারাই টেন্ডার আহ্বান করেছেন। তারপর দরপত্র মূল্যায়ন করে মন্ত্রণালয় মনে করেছে আউটপুটের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি। তাই বর্তমান সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় সরকার মনে করছে আপাতত এ ধরনের প্রজেক্ট করা ঠিক হবে না।’
তবে ৫৮ কোটির বেশি খরচ হলেও সেটাকে অপচয় মানতে রাজি নন ফজিলাতুন নেসা। তার মতে, ‘বাংলাদেশে যেহেতু এ ধরনের প্রজেক্ট প্রথম। তাই এ ধরনের কাজ করতে গিয়ে বিদেশি পরামর্শকদের সঙ্গে আমাদের কর্মকর্তারা কাজ করেছেন। ফলে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতে কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড সাব-স্টেশন নির্মাণ করতে গেলে তাদের দক্ষতা কাজে লাগবে।’
এদিকে গত ২৭ ডিসেম্বর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। প্রতিবেদনে আইএমইডি জানিয়েছে, অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে বাস্তবায়ন ব্যয় অত্যধিক বেশি হওয়া অনুমোদিত কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্প সমাপ্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। চুক্তি সমাপ্ত, চুক্তি অনুযায়ী কাজের বিল পরিশোধ এবং সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াগুলো সম্পাদনসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনায় ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ছয় মাস বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, জাইকার অর্থায়নে ডেসকোর মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের মূল ডিপিপি অনুমোদনের পর জাইকার গাইডলাইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগের লক্ষ্যে প্রকল্পের ডিজাইন, টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রস্তুত এবং দরপত্র আহ্বান করা হয়। জাইকার গাইডলাইন অনুযায়ী কারিগরি মূল্যায়ন সম্পন্ন করা হয় এবং দরপত্রের আর্থিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে অত্যধিক বেশি হওয়া সত্ত্বেও জাইকা ফের বিবেচনা করার অনুরোধ জানায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে জাইকা বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারদর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকাদারদের প্রস্তাবিত দরের বিপরীতে বুয়েট কর্তৃক কারিগরি মতামত গ্রহণ করা হয়। বুয়েটের মতামতে ব্যয় অত্যধিক বেশি হিসেবে উল্লেখ করা হলে জাইকার সম্মতি এবং টেন্ডার ডকুমেন্ট ও প্রাক্কলন প্রয়োজনীয় সংশোধনপূর্বক ফের দরপত্র আহ্বান প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। পুনঃদরপত্রেও প্রকল্পটির ব্যয় প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় অপেক্ষা অত্যধিক বেশি হওয়ায় প্রকল্পের অনুমোদিত কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্প সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।-কালবেলা