১৭, নভেম্বর, ২০২৪, রোববার
     

৩০-৭০ পয়সা বাড়ছে বিদ্যুতের দাম

মূল্যস্ফীতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস। দৈনন্দিন খরচের হিসাব মেলাতে পারছে না মানুষ। এ অবস্থায় ফের বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। গ্রাহক শ্রেণি অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩০ থেকে ৭০ পয়সা পর্যন্ত বাড়তে পারে। অন্যদিকে, গ্যাসের দামও বাড়বে। আগামী সপ্তাহে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। নতুন দর ১ মার্চ থেকে কার্যকর হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটা দাম বৃদ্ধি নয়, সমন্বয় করা হচ্ছে। কারণ দেশের বাজারে মার্কিন ডলারের দাম বেড়েছে। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ ঘাটতি মেটাতে এবং জ্বালানির দাম যেহেতু ডলারে পরিশোধ করতে হয়, তাই মূল্য সমন্বয় করতে হচ্ছে। এ ছাড়া সরকার পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেওয়া ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি মার্চ থেকে কার্যকর হবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশেও জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা করবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ প্রসঙ্গে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, দেশের বাজারে ডলারের দাম বেড়েছে। ফলে আমাদের খরচ বেড়ে গেছে অনেকখানি। এ কারণে এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এটা দাম বাড়ানো নয়, ডলার প্রাইসের কারণে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সে জায়গাটা সমন্বয় করা হচ্ছে।

মার্চে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়বে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুতের দাম লাইফ লাইন গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি ৩০ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরের গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি ৭০ পয়সা বাড়বে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ক্যাপটিভ পাওয়ারে যে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, সেখানেও দাম বাড়বে ইউনিটপ্রতি (এক হাজার ঘনফুট) ৭০ পয়সা। তিনি বলেন, তেল আনব, এলএনজি আনব, ডলার নেই। কয়লার বিল দেওয়া যাচ্ছে না।

জানা গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। পাশাপাশি ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে ভর্তুকিমুক্ত করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ রয়েছে। এ পটভূমিতেই বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সঙ্গে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় দাম সমন্বয় পদ্ধতি চালু হচ্ছে।

আগামী তিন বছরের মধ্যে সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পর্যালোচনা বলছে, ভর্তুকি তুলে দিলে বিদ্যুতের দাম ৭৮ শতাংশ বাড়তে পারে। সংস্থাটির সুপারিশ, ধাপে ধাপে দাম বাড়ালে জনগণের জন্য সহনীয় হবে। ফলে চলতি বছর কয়েক ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবির ভর্তুকির প্রয়োজন ছিল ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা।

২০০৯ সালে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। সে সময় বিদ্যুতের খুচরা দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। গত ১৫ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ১৭৪ মেগাওয়াট। উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে বিদ্যুতে আমদানি করা জ্বালানির ব্যবহার বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও বাড়ে জ্বালানির দাম। ফলে বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ ও গ্রাহক পর্যায়ে দাম। প্রতি ইউনিটের খুচরা দাম হয়েছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। ২০১০ সালের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম ১২ বার বেড়েছে। শুধু ২০২৩ সালেই তিন দফায় বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম নির্বাহী আদেশে বাড়ে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি।

এ ছাড়া গত বছরের ১৮ জানুয়ারি শিল্পসহ অন্য খাতে গ্যাসের দাম রেকর্ড ১৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। সবচেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। আমদানি করা এলএনজিসহ বর্তমানে প্রতি ইউনিট (এক হাজার ঘনফুট) গ্যাসে সরকারের খরচ হচ্ছে ২৪ টাকা। বিদ্যুতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৪ টাকা। লোকসান কমাতে এই খাতে গ্যাসের দাম ইউনিটপ্রতি ৭০ পয়সা বাড়ানো হচ্ছে। শিল্পে নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র বা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট, সব ধরনের শিল্প (বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র) গ্রাহকের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম এখন ৩০ টাকা। এই শ্রেণিতে ইউনিটপ্রতি ৭০ পয়সা বাড়ানো হচ্ছে। তবে পেট্রোবাংলা চাইছে সিএনজি ও সারেও গ্যাসের দাম বাড়াতে। কৃষির খরচ বাড়বে বলে সরকার এতে রাজি হচ্ছে না। সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট ১৬ টাকা। সিএনজিতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৪৩ টাকা। আর রান্নার গ্যাসের জন্য দুই চুলার (ডাবল বার্নার) মাসিক বিল ১ হাজার ৮০ টাকা এবং এক চুলার মাসিক বিল ৯৯০ টাকা, যা ২০২২ সালের ৫ জুন বাড়ানো হয়।

আইএমএফ গত সেপ্টেম্বর থেকে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি (অটোমেটেড প্রাইসিং ফর্মুলা) কার্যকর করার শর্ত দিয়েছিল। আইএমএফের শর্ত পূরণে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেনসহ জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে নিয়মিত সমন্বয় করার উদ্যোগ নেয় সরকার। শুরুতে এটি তিন মাস পরপর নির্ধারণের পরিকল্পনা ছিল। এখন প্রতি মাসে দাম নির্ধারণের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে। দাম নির্ধারণ পদ্ধতির বিষয়ে বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, তেলের দাম নির্ধারণের দুটি অংশ থাকবে। প্রিমিয়াম (জাহাজ ভাড়া ও অন্যান্য), ট্যাক্স, বিপণন মার্জিন, ডিলারদের কমিশন ইত্যাদি মিলে একটি নির্ধারিত অংশ থাকবে, যা সাধারণত পরিবর্তন হবে না। অন্য অংশটি আন্তর্জাতিক দরের সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়বে বা কমবে। ফর্মুলা প্রণয়নে ভারতের জ্বালানি তেলের দরও বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

বর্তমানে দেশের বাজারে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ১০৯, অকটেন ১৩০ এবং পেট্রোল ১২৫ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। বিপরীতে আন্তর্জাতিক বাজারে এখন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি ব্যারেল ৭৯ থেকে ৮৩ ডলারের মধ্যে।

               

সর্বশেষ নিউজ