২২, ডিসেম্বর, ২০২৪, রোববার
     

যে বীভৎসতা দেখে কাঁদে পাষাণের হৃদয়ও

ভ্যান গাড়িতে কয়েক তরুণের মরদেহ স্তূপ করে রাখা। সেগুলো নীল জমিনে লাল-সাদা ছাপা বিছানার চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা। পুরো লুকানো সম্ভব হয়নি। ভ্যান থেকে ঝুলছিল কারও রক্তাক্ত হাত-পা। নিথর দেহে কারও মাথা ঝুলে ছিল। বীভৎস, নৃশংসতার সাক্ষী হয়েছিল ঝুলে থাকা হাত-মাথা।

পুলিশের বুলেটপ্রুপ জ্যাকেট-হেমলেট পরা দুই ব্যক্তি আরও এক তরুণের নিথর দেহ ছুড়ে মারছিলেন থেমে থাকা সেই ভ্যানে। প্রথম দফায় ব্যর্থ হন তারা, পরের বারের চেষ্টায় সেই মরদেহ ছুড়ে মারা হয় আগে থেকে স্তূপ করা লাশের ওপর। এরপর তা ধুলা ভরা-ছেঁড়া ব্যানারে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা হয়। ভ্যানটির আশপাশে ঘিরে ছিলেন অস্ত্র হাতে পুলিশের কয়েকজন সদস্য। গত শুক্রবার ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের এমন ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে গুলি করে হত্যার পর লাশ নিয়ে পুলিশের এমন নিষ্ঠুরতা, তা সবাই নিশ্চিত ছিল। কিন্তু এই বীভৎসতা কোথায়? তা নিশ্চিত ছিলেন না কেউ। তবে ভিডিওতে দেখা যাওয়া দেয়ালে সাঁটানো পোস্টার আর বালুর বস্তার স্তূপ দেখে গতকাল শনিবার নিশ্চিত হওয়া যায়, এমন নৃশংতার ভিডিও ঢাকার অদূরে আশুলিয়া থানার সামনে ঘটে গত ৫ আগস্ট। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা তা নিশ্চিত করেছেন ভিডিওতে দেখা যাওয়া পুলিশের এক পরিদর্শককে দেখে। ওই পরিদর্শকের নাম আরাফাত হোসেন। তিনি ঢাকা জেলা গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগে কর্মরত। ফ্যাক্ট চেকিং রিউমার স্ক্যানিংয়েও ধরা পড়ে ভিডিওটি আশুলিয়া থানার সামনে। স্থানীয়রা বলছেন, ৫ আগস্ট বিকেলে ঘটে এমন ঘটনা।

ঢাকা জেলা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কালবেলাকে জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে আশুলিয়া থানার ওসি এএফএম সায়েদ আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। যদিও ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে তাকে দেখা যায়নি।

ভিডিওর ১ মিনিট ৬ সেকেন্ডে একটি পোস্টার দেখা যায়, যা স্থানীয় যুবলীগের ধামসোনা ইউনিয়ন সভাপতি ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেনের। সেই পোস্টারটি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ঘটনাস্থল আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের পেছনের সড়ক দিয়ে থানা রোড অতিক্রম করে এসবি অফিসের দিকে যাওয়ার সময় ডান পাশের দেয়ালটি হুবহু ভিডিওর সঙ্গে মিলে যায়। সেই পোস্টারটি এখনো দেয়ালে রয়েছে। মহাসড়ক থেকে থানার দিকে যেতে এসবি অফিসের দিকে চৌরাস্তায় ওই নৃশংস ঘটনা ঘটে।

স্থানীয়রা বলছেন, ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতা আশুলিয়া থানার সামনে জড়ো হয়। পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। থানার আশপাশের সড়কে অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ নিহতদের একটি ভ্যানে করে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। এমনকি পুলিশের একটি গাড়িতে কয়েকজনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় বলেও দাবি স্থানীয় লোকজনের।

আশুলিয়া থানার সামনের দোকানি মো. ফাহিমা বলেন, ভিডিওটি আশুলিয়া থানার সামনে থেকেই করা। আশুলিয়া থানার পাশেই কিছু বালুভর্তি ব্যাগ ছিল, যা ভিডিওতে দেখা গেছে। স্থানীয় আরেক ব্যক্তি মো. মনোয়ার বলেন, ৬ আগস্ট সকালে আশুলিয়া থানার সামনে গিয়ে তিনি দেখেন ভ্যানে কয়েকটা পোড়া মরদেহ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেদিন আশুলিয়া এলাকায় একটি ড্রোন উড়িয়ে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার অবস্থান শনাক্ত করা হয়। তবে সেটি পুলিশের ড্রোন কি না নিশ্চিত হওয়া যায়নি। থানার বিভিন্ন গলিতে ছাত্র-জনতা প্রবেশ করলে তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে পুলিশ। ওই সময় বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পুলিশ মরদেহ তাদের থানার সামনে নিয়ে যায়। সেখানে একটি পুলিশভ্যানে লাশগুলো রেখে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বলেও দাবি তাদের।

ভিডিওতে মাথায় হেলমেট পরিহিত ডিবি পরিদর্শক আরাফাত হোসেন বলে শনাক্ত করেন স্থানীয়রা। গতকাল আরাফাতের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি-উত্তর) ইনচার্জ রিয়াজ উদ্দিন বিপ্লব বলেন, আরাফাত হোসেন নামে এক পরিদর্শক ঢাকা উত্তরের ডিবি পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ভিডিওর ওই পুলিশ সদস্য আরাফাত কি না নিশ্চিত নই।

পুলিশ সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফীর নেতৃত্বে ঢাকা জেলা ডিবি ওই এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছে।

স্থানীয় সূত্র বলছে, পুলিশ কর্মকর্তা কাফী সাভার-আশুলিয়া এলাকায় মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন। ওই এলাকায় তিনি ‘ভাড়ায় খেটে’ প্রভাবশালীদের হয়ে জমি ও কারখানা দখল করার কাজে সহযোগিতা করতেন। বিভিন্ন শিল্পকারখানা থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিতেন। নিজেকে পরিচয় দিতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলে সাফি মোদাচ্ছের খানের বন্ধু হিসেবে।

কে এই আরাফাত: ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে প্রায় সবার পরনে পুলিশের জ্যাকেট ও হেলমেট থাকলেও কারোই পুলিশের পোশাক ছিল না। ওই ভিডিওতে ঘটনাস্থলে অনেক জুতা-স্যান্ডেল পড়ে থাকতে দেখা যায়। ভ্যানের আশপাশে ছিল ছোপ ছোপ রক্ত। তবে এর মধ্যেই হেলমেট পরা পুলিশের একজনকে বেশ তৎপর দেখা যায়। স্থানীয় লোকজন বলছেন, তিনিই ডিবি পরিদর্শক আরাফাত হোসেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই আরাফাতের গ্রামের বাড়ি বরিশালে। দুই বছর আগে ঢাকা জেলার গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেন তিনি। পড়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে।

ভিডিও দেখার পর স্থানীয় সূত্র জানায়, আরাফাতের বাবা আরিফ হোসেন বরিশালে স্থানীয় বদরটুনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তিনি হরিনাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন।

জানা গেছে, সাভার ও আশুলিয়ায় গত ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৭৫ জন। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন চার শতাধিক মানুষ। যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন।

ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মঈদ গতকাল কালবেলাকে বলেন, ভিডিওটি তারা দেখেছেন। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ সদস্যদের শনাক্তসহ পুরো ঘটনা তদন্তে কমিটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ডিবি পরিদর্শক ঘটনার পর থেকে পলাতক। তা ছাড়া অন্যদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

               

সর্বশেষ নিউজ