১৬, অক্টোবর, ২০২৪, বুধবার
     

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫-৩৭ করার প্রস্তাব, কেমন হবে এর প্রভাব?

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ছেলেদের জন্য ৩৫ আর মেয়েদের জন্য ৩৭ বছর করার সুপারিশ সম্বলিত প্রস্তাব দিয়েছে সরকার গঠিত পর্যালোচনা কমিটি।

এ খবরকে স্বাগত জানিয়ে আন্দোলনকারীরা ওই সুপারিশের ভিত্তিতে আগামী তিনদিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারির দাবি করেছে।

যদিও সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের কয়েকজন বলেছেন, এতে ক্যাডার সার্ভিসগুলোতে চাকরির পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে এবং সার্ভিস কমান্ড নষ্ট হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।

বর্তমানে দেশে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে সাধারণ কোটায় আবেদন করা যায় আর অবসরে যাওয়ার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫৯ বছর।

তবে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ অন্যান্য কোটার ক্ষেত্রে এ বয়স সীমা ৩২ ও ৬০ বছর নির্ধারণ করে আছে।

এক যুগ আগে ২০১২ সাল থেকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করার দাবিতে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ নামে একটি সংগঠন আন্দোলন শুরু করে। তারা বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে এ নিয়ে তাদের দাবি জানিয়ে আসছিলো।

সবশেষ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর ‘চাকরিতে বয়সের আবেদনসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ’ আন্দোলন শুরু করলে সরকার একটি কমিটি করে দেয়।

সাবেক উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিটির কাজ বিষয়টি যাচাই বাছাই করে সরকারের কাছে সুপারিশ দেয়া।

এদিকে, চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ ও অবসরের বয়স ৬৫ বছর করতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ গত পাঁচই সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আবেদন করেছে।

এই প্রেক্ষাপটে গত ১৮ই সেপ্টেম্বর সে চিঠি বা প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

সুপারিশ ও তিন দিনের আল্টিমেটাম

সরকারি চাকরির বয়সসীমা নিয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সুপারিশ সম্পর্কে গণমাধ্যমে কোন মতামত প্রকাশ করেনি।

তবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে যেসব খবর এসেছে তাতে জানা যাচ্ছে, গত সপ্তাহে এ কমিটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে বয়সসীমা বাড়ানোর যৌক্তিকতা প্রকাশ করে সরকারের কাছে রিপোর্ট দিয়েছে।

এতে চাকরিতে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে মেয়েদের জন্য এটি ৩৭ করার পক্ষে মতামত দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে, চাকরিতে বয়সের আবেদনসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ এর আহ্বায়ক শরিফুল হাসান শুভ বলছেন, তারা তথ্য পেয়েছেন যে এটিই কমিটির একমাত্র প্রস্তাব নয়।

বরং তারা কতগুলো বিকল্পও ওই প্রস্তাবনায় রেখেছেন, যাতে ৩২ বা ৩৩ বছরের সীমার কথাও বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, ৩৫-৩৭ বছর আমাদের প্রত্যাশার প্রতিফলন। সার্বিক বাস্তবতায় এটিই গ্রহণ করা হবে বলে আমরা আশা করছি।

ওদিকে, পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন জারির জন্য তিন দিনের সময় বেঁধে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

আর সেটি না করা হলে আবারও আন্দোলনে নামার কথা জানিয়ে রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করেছে তারা।

আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র ইমতিয়াজ হোসাইন বলেছেন, বর্তমান সরকার তাদের আবেগকে মূল্যায়ন করেছে এবং তারা একটি কমিশন গঠন করেছে।

তিনি বলেন, যেহেতু এই কমিশন আমাদের যুক্তি শুনে কথা বলে ও গবেষণা করে পুরুষের জন্য ৩৫ বছর এবং নারীদের জন্য ৩৭ বছর করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে – আমরা চাই সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করা হোক।

এর প্রভাব কেমন হতে পারে?

বাংলাদেশে গত এক যুগের বেশি সময় ধরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বৃদ্ধির আলাপ থাকলেও, বয়সসীমা বাড়ানোর যৌক্তিকতা কতটা, সেটি নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন।

সেই সাথে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হলে সেটি কি রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সাথে মিলে দেশের জন্য বোঝা তৈরি করতে পারে – তেমন প্রশ্নও রয়েছে অনেকের মধ্যে।

সরকারের সাবেক কর্মকর্তাদের কয়েকজন বিবিসিকে বলছেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা এভাবে বাড়ানো হলে তা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হবে বলে মনে করেন তারা।

তাদের মতে কেউ ৩৫ বছরে আবেদন করলে তার লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, পুলিশ ভেরিফিকেশন ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে চাকরি হতে হতে আর তিন থেকে চার বছর সময় চলে যাবে, যার অর্থ হলো তার কর্মজীবনই শুরু হচ্ছে প্রায় ৪০ বছর বয়সে।

সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ২০১৮ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়স যদি ৩৫ করা হয় তাহলে তরুণদের মেধাকে কাজে লাগানো যাবে না। তরুণরা যে অনেক দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে সেটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন?

বর্তমানে মজুমদার এখন সরকারের একজন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।

সরকারের সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলছেন, এভাবে ক্যাডার সার্ভিসের অল্প কিছু চাকরির জন্য বয়সসীমা বাড়ানো হলে তা খুব একটা সুফল দিবে না।

আবার এসব কর্মকর্তাদের অবসর বয়সসীমা কেমন হবে সেটিও একটি প্রশ্ন হবে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, বরং আমাদের উচিত হবে তরুণদের বেশী করে সুযোগ দেওয়া।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের সময় একবার ক্যাডার সার্ভিসের জন্য আবেদনের বয়স ৫০ বছর পর্যন্ত করা হয়েছিল। ৮২ ব্যাচের ওই কর্মকর্তারা ‘৬৫০ ক্যাডার’ হিসেবে প্রশাসনে পরিচিত।

এসব কর্মকর্তাদের মধ্যে তখন ৪৫ বছরের বেশি বয়সে চাকরি পেয়েছিলেন ২০ জনের মতো।

মূলত উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তনের কারণে প্রতিটি উপজেলায় ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করতে হবে – এমন চাহিদা থেকে তখন একটি বিসিএসের জন্য বয়সসীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ওই ব্যাচেরই একজন কর্মকর্তা আ ক ম সাইফুল ইসলাম পরে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে যান। তিনি ২৬ বছর বয়সে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন।

সাইফুল ইসলাম বলেন, একই পদে কেউ ২৫ বছর, কেউ ৩৫ বছর কিংবা আরও বেশি- এমনটা হলে সার্ভিস কমান্ড নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের সময়ে যারা অনেক বেশি বয়সে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জয়েন করেছিলেন, তাদের থেকে অনেক কম বয়সীরা তখন ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) ছিল। সেজন্য অনেকেরই অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। কাজ করাটাও অনেকের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া ২৪/২৫ বছর বয়সের একজন তরুণ কর্মকর্তাকে সরকার যেভাবে কাজের জন্য গড়ে তুলতে পারবে ৪০ বছর বয়সী কাউকে দিয়ে সেটা সম্ভব হবে না। তরুণ কর্মকর্তারা চাকরি জীবনের শুরুতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে আনন্দ পান, যেটা পরিবার পরিজন ফেলে চল্লিশোর্ধ্ব কারও পক্ষে সহজ নাও হতে পারে।

পররাষ্ট্র, পুলিশ ও প্রশাসনসহ কিছু সার্ভিসে বরং বয়সসীমা কমিয়ে ২৭ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে দায়িত্ব পালনের জন্য এসব সার্ভিসে প্রবেশের বয়সসীমা কমিয়ে ২৭ করলে দেশ উপকৃত হবে।

কিন্তু অনেক দেশেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নেই – এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন সেসব দেশে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন স্থানীয় সরকারের হাতে এবং তারা ইচ্ছে মতো নিয়োগ বা অব্যাহতি দিয়ে থাকে। নিউইয়র্কের পুলিশ নিউইয়র্ক সিটির নিয়ন্ত্রণে। তারাই নিয়োগ দেয় বা অব্যাহতি দেয়। বাংলাদেশে কী সেটি সম্ভব হবে?

সাবেক কর্মকর্তারা মনে করেন, চাকরি ক্ষেত্র ছাড়া সামাজিকভাবেও এর প্রভাব পড়বে এবং শিক্ষিত উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে অনীহা তৈরি হবে।

ফলে শিক্ষিত অনেকে দীর্ঘকালীন বেকারত্বের চক্রে আটকে পড়তে পারেন-এমন আশঙ্কাও আছে অনেকের মধ্যে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

               

সর্বশেষ নিউজ