২১, ডিসেম্বর, ২০২৪, শনিবার
     

নিয়ম ভেঙে সরকারকে ঋণ দেন সাবেক গভর্নর

নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছেন সরকারকে। ওয়েস অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স (ডব্লিউএমএ) থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং ওভার ড্রাফট (ওডি) থেকে নেওয়া হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে উইন্ডো দুটির প্রতিটি থেকে জরুরি প্রয়োজনে আট হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার সীমা ছিল। জুলাই ও আগস্টে আন্দোলনের সময়ে প্রতিটি উইন্ডো থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা করে মোট ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ ঋণসীমার অতিরিক্ত চার হাজার কোটি টাকা করে বেশি ঋণ দেওয়া হয়। যার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি এ পদক্ষেপের ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের অভিমত-সাবেক গভর্নর রউফ তালুকদার একচ্ছত্র নিয়মকানুনের পাত্তা দিতেন না। সরকারকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মের বিষয়টি তিনি আমলে নেননি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন অর্থ উপদেষ্টা ও নতুন গভর্নর এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে অনুমোদন দিয়েছেন।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ধার দেওয়ার মানে টাকা ছাপানো। সরকারকে এত বেশি ঋণ দেওয়ার অর্থ মূল্যস্ফীতিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওডি এবং ডব্লিউএমএ থেকে নির্ধারিত সীমা না মেনে ঋণ দেওয়ার অর্থ এটি অনিয়ম হয়েছে। বিগত সময়ে যা ঘটেছে সেটি কিভাবে হলো খতিয়ে দেখে আগামীতে যাতে এ ধরনের অনিয়ম না হয় তা নিশ্চিত করা দরকার। এক্ষেত্রে রক্ষাকবচ অতীতে কাজ করেনি, সেটি চিন্তা করে আগামীতে কি ধরনের রক্ষাকবচ দেওয়া যায় সেটিও ভাবতে হবে।

সরকারি চাকরিতে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে ১ আগস্ট বৃহস্পতিবার ঘটনাত্তোর অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর সাপ্তাহিক ২ দিন ছুটির পর ৪ আগস্ট অফিস খোলা ছিল। ওই দিন কারফিউ ভেঙে ছাত্র-জনতা সরকার পতনের একদফা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। এর পরদিন ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। যে কারণে এই ঋণের ঘটনাত্তোর অনুমোদন দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। গভর্নর পদত্যাগ করে পালানোর কারণে এ নিয়ে এ ঋনের অনুমোদন নেওয়া হয়নি, কিন্তু সরকার টাকা ধার করে চলেছে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, অর্থ উপদেষ্টা ওডি এবং ডব্লিউএমএ খাতের সীমা লঙ্ঘন করে ধার করার প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়ার অর্থ হচ্ছে আগের অনিয়মকে হালাল করে নেওয়ার শামিল। কিন্তু অনুমোদন না দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ আগেই সাবেক গভর্নর সীমার অতিরিক্ত ঋণ দিয়েছে সরকারকে। তবে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওডি এবং ডব্লিউএমএ খাত থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে পর্যায়ক্রমে।

সাধারণভাবে সরকার দুভাবে ঋণ গ্রহণ করে। এক অভ্যন্তরীণ (ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও বিবিধ) এবং দ্বিতীয় বৈদেশিক উৎস থেকে। ব্যাংকের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে ট্রেজারি বিল ও বন্ড ইস্যু করে ঋণ নেয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ১ লাখ ২৪ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ঋণ করেছে। সরকারকে দেওয়া ঋণের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই দেয় ৭৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ দেওয়া হবে না।

সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ দেখানো হয় ৯৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে দেখানো হয় ৯৭ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংকে ঋণ না বেড়ে উলটো ৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা কমেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সূত্রমতে, ট্রেজারি বিল ও বন্ড ছাড়াও সরকার জরুরি প্রয়োজনে ‘উপায়-উপকরণ আগাম’ এবং ‘ওভার ড্রাফট’ হিসাবে ঋণ নিতে পারে। গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত ‘উপায়-উপকরণ আগাম’ ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারিত ছিল আট হাজার কোটি টাকা এবং ওডি থেকে ঋণ নেওয়ার সীমা ছিল আট হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত যা ছয় হাজার কোটি টাকা ছিল। তবে গত অর্থবছরের শেষ সময়ে সীমা চেয়ে বেশি অর্থাৎ ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এই দুটি উইন্ডো থেকে ঋণ সীমার বেশি সরকারের জরুরি টাকার দরকার হলে নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করে তা নিতে পারবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে ‘ওভার ড্রাফট’ খাতের সীমা সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করতে পারে। তবে ঋণ ৯০ দিনের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। কিন্তু এ নিয়মের তোয়াক্কা না করে সরকারকে ওভার ড্রাফট এবং ডব্লিউএমএ খাতে ঋণ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু সে নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি।

সূত্রমতে, নেতিবাচক নগদ-ভারসাম্য পরিস্থিতির কারণে এপ্রিল-জুলাই পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েস অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স (ডব্লিউএমএ) এবং ওভার ড্রাফট (ওডি) থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল। মূলত সরকারের একদিকে ব্যয় বেড়ে যাওয়া অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি এ দুটি বিষয় সরকারের লেনদেন বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। আর এটি সামাল দিতে গিয়ে সরকারের দৈনিক যে ঋণের সীমা আছে সেটি অতিক্রম করে যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির মাধ্যমে ৪৭,২০৯ ধার করেছে। গত অর্থবছরের একই সময় শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ধার করেছিল ২৪,৪৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ধার বেড়েছে প্রায় ৯৩ শতাংশ।

               

সর্বশেষ নিউজ