মোহাম্মদ মোক্তার হোসেন-
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুসারে সন্দেহজনকভাবে কাউকে গ্রেফতার এবং আটক ব্যক্তিকে ১৬৭ ধারা অনুসারে পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে (রিমান্ড) জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। হাইকোর্ট এ দুটি ধারা সংশোধন করার পাশাপাশি সেগুলো সংশোধনের আগে সরকারকে ১৫ দফা নির্দেশনা অনুসরণ করার রায় দিলে রাষ্ট্রপক্ষ এ আপিল করেছিল। আপিল বিভাগের রায়ের ফলে আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য পুলিশ আর কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না। গ্রেফতারের সময় পুলিশকে পরিচয়পত্রও দেখাতে হবে। তা ছাড়া গ্রেফতার করার তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে। বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কোনো স্থান থেকে কাউকে গ্রেফতারের এক ঘণ্টার মধ্যে তার নিকটাত্মীয়কে টেলিফোনে বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে তা জানাতে হবে। আপিল বিভাগের রায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১৫ দফা নির্দেশনা ও সুপারিশগুলো কিছু সংশোধন-সংযোজন সাপেক্ষে বহাল রাখা হয়েছে, যা আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে বিস্তারিত জানা যাবে।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে গতকাল মঙ্গলবার সংক্ষিপ্ত রায় দেন। এ রায়ের ফলে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও পুলিশি হেফাজতে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে এক যুগ আগে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, সেটিই বহাল হলো।
আপিল বিভাগের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ গণমাধ্যমকে বলেছেন, আপিল বিভাগের এই রায় যুগান্তকারী। এর ফলে জনগণের মৌলিক অধিকার আরও সুরক্ষিত হবে। এতদিন এই ঔপনিবেশিক আইনগুলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়নি। এবার এগুলোকে জনগণের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার রক্ষার সঙ্গে সাযূজ্যপূর্ণ করা সম্ভব হবে। আইনের অপব্যবহারকারী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও অপরাধী চক্রের সদস্য উভয়কেই আইনের আওতায় আনা সম্ভবপর হবে।
রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আইনে কিছু কিছু ইমার্জেন্সি প্রভিশন থাকে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে ৫৪ ধারা ইমার্জেন্সি প্রভিশন হিসেবেই রাখা হয়েছে। এটা ভালো নাকি মন্দ, সেটা ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। তবে আদালত নির্দেশনা দিলে সরকার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। জনগণের উপকারে ফৌজদারি কার্যবিধি যদি আরও সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তাহলে তা করা হবে।’
রায় ঘোষণার সময় আদালত :সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার সময় আপিল বিভাগ বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ (ডিসমিসড) করা হলো। তবে হাইকোর্টের রায়ের নির্দেশনাগুলোতে কিছু সংশোধন-সংযোজন করা হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে।’ এ সময় আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রিটকারীদের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে দেওয়া নির্দেশনা ও সুপারিশ ছয় মাসের মধ্যে সরকারকে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল। ওই রায় আপিল বিভাগ কখনও স্থগিত না করলেও সরকার সেটি এখনও বাস্তবায়ন করেনি।’
এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করে দেব, সরকার যত দিন ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধন না করবে, তত দিন এ রায় সংবিধান অনুসারে কার্যকর থাকবে।’
আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, আইনজীবী সারা হোসেন প্রমুখ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া :
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আপিল বিভাগ যে রায় দেবেন বা যেসব নির্দেশনা দেবেন, তার আলোকে আশা করি, সরকার পদক্ষেপ নেবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আদালতের মূল উদ্বেগ হচ্ছে, মানবাধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয়।’
৫৪ ধারায় গ্রেফতার-সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘সাদা পোশাকে নিজেদের পরিচয় না দিয়ে পৃথিবীর কোথাও কাউকে গ্রেফতার করা হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে শত্রুতাবশত এভাবে একজনকে গায়েব করে ফেলা হচ্ছে। পরিচয় দেওয়া হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক। আশা করি, এটা বন্ধ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাদা পোশাকে যারা দায়িত্ব পালন (গ্রেফতার) করবেন, তাদের কাজ হবে আসামিকে অনুসরণ করা, গতিবিধি লক্ষ্য করা। তাকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে নিশ্চয়ই পরিচয় দেওয়া উচিত।’
৫৪ ধারার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সব সময় আগে থেকে মামলা করে আসামি ধরা সম্ভব হয় না। অপেক্ষা করে বসে থাকলে সে পালাবে। যেমন- যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু (আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু) রাজাকার গ্রেফতারের নির্দেশ শুনে পালিয়েছে। তাই কোনো কিছু জেনারালাইজ করা যাবে না। আশা করি, আদালত বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করবেন।’
রিট আবেদনকারীর পক্ষের আরেক আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমান বলেন, ‘আপিল বিভাগ বলেছেন, হাইকোর্টের সুপারিশগুলো কিছু সংশোধন করে একটি গাইডলাইন (দিকনির্দেশনা) দেওয়া হবে। গাইডলাইনে কী থাকবে, তা পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে জানা যাবে।’ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘এ রায়ের ফলে হাইকোর্টের রায় প্রতিপালনে সরকারের এক ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হলো। ১৮ বছরের আইনি প্রতীক্ষারও অবসান ঘটল।’
হাইকোর্টের ১৫ দফা নির্দেশনা: হাইকোর্টের দেওয়া ১৫ দফা নির্দেশনা হলো_ আটকাদেশের (ডিটেনশন) জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না; কাউকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ অবশ্যই তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে; আটক ব্যক্তির শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে পুলিশকে ডাক্তারি সনদও নিতে হবে; গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে আটক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে; বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে আটক ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত জানাতে হবে; গ্রেফতার ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে; আটক ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের ভেতরে কাচঘেরা বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে; তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন; জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে; পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন এবং বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নেবেন; পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেফতার ব্যক্তি মারা গেলে তাৎক্ষণিকভাবে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে; এবং কারা বা পুলিশ হেফাজতে আটক ব্যক্তি মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দেবেন।
প্রেক্ষাপট:
১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই রাজধানীর মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে মতিঝিল থানার পুলিশ হেফাজতে আটক বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শামীম রেজা রুবেলের মৃত্যু হয়। তাকে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। এ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন দেখা দেয়। এ পর্যায়ে তৎকালীন সরকার বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। পরে সরকার ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন না করায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার এবং ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করে। ওই রিটে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ফৌজদারি আইন সংশোধন করতে সরকারকে ১৫ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। পাশাপাশি আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত তা মেনে চলার নির্দেশ দেন আদালত। পরে ওই বছরের ৪ আগস্ট হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি লিয়াকত শিকদার ও সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম কোতোয়ালের গ্রেফতারের ঘটনায় একই বিষয়ে আরও একটি রায় দেন। এর পর হাইকোর্টের ওই দুটি রায় স্থগিতের আবেদন করা হলে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত তা বহাল রাখেন। এর পর এ আবেদন ২০০৭, ২০০৮, ২০১০ সাল এবং চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি চারবার শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় এলেও শুনানি হয়নি। প্রায় ১৩ বছর পর গত ২২ মার্চ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চে ওই আপিলের শুনানি শুরু হয়। দুই কার্যদিবস শুনানি শেষে আদালত ১৭ মে রায়ের দিন ধার্য করেন।