২১, ডিসেম্বর, ২০২৪, শনিবার
     

জীবন যুদ্ধে সফল এক মহিয়শী নারীর গল্প

নারী মানেই সংসার আর সন্তান সামলাবেন, নারী মানেই বছর বছর সন্তান জন্ম দিবেন, নারী মানেই জীবন সংসারের সকল অন্যায় অত্যাজার মুখ বুঝে সহ্য করবেন- কিছুদিন আগেও সমাজে এই ধারণা ছিল প্রকট। দেশের নানা প্রান্তে আজও এই ধারণা পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সামাজিক ও পারিবারিক নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বৃত্ত ভেঙে সফল হয়েছেন অনেকেই। তেমনই আজ আপনাদের শুনাবো জীবন যুদ্ধে সফল এক মহিয়শী নারীর গল্প ।

নাম লায়লা আঞ্জুমান । শক্ত অভিভাবকহীন মফস্বলে বেড়ে উঠা অতি সামান্য ঘরের মেয়ে । পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার কেউই নেই তবে সামনে ধেকে ধাক্কা দেয়ার লোকের অভাব নেই এমন এক সমাজ থেকে বেগে উঠা এই লায়লা ।

বেড়ে ওঠার গল্পটা খুব সহজ ছিল না। সান সওকাত না থাকায় পরিবারে ছন্দপতন হয়। তবে লেখাপড়ায় ভালো থাকায় পরিবারের সবার উৎসাহ পেয়েছেন। অনেক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের মধ্যেই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়েছেন ।

মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে একটি রক্ষনশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি । শৈশব কাটে সেখানেই । শিক্ষাজীবন শুরু হয় সৈয়দপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সৈয়দপুর আব্দুর রহমান হাই স্কুল & কলেজ থেকে কৃতিত্বে সহিত মাধ্যমিক পাশ করেন । ১ম হইতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি প্রথম স্থান এর অধিকার করেন । তার ইচ্ছা ছিল এইচ.এস.সি তে পড়াশোনা করবে এবং ভালো রেজাল্ট করে ডাক্তারি পড়বে। কিন্তু গ্রমের মেয়ে বলতে এস.এস.সি পরীক্ষা পাস করা মানেই বিয়ের বয়স হয়ে যাওয়া। বিয়ে দিতেই হবে, না হয় মেয়ের বয়স হয়ে যাবে।

তাই বিয়ের জন্য পরিবারের লোকজন তাকে চাপ দিতেছিল ।তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, গ্রামের বাসায় থাকলে তার আর লেখাপড়া করা হবে না এবং তার স্বপ্নের ডাক্তারি পড়াও হবে না। তাই তিনি নিজের ইচ্ছাকে বাস্তবায়নের জন্য একজন সাহসী যোদ্ধা নারীর মত সাহস নিয়ে নিজের ইচ্ছায় তিনি ঢাকা চলে আসলেন জীবন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য ।

ভর্তি হলেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট হলি ফ্যামিলি কলেজের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং এ। এরপর হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা চালাতে শুরু করলেন। পাশাপাশি মগবাজার সিদ্ধেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয়ে এইচ এস সি তে ভর্তি হলেন এবং শুরু হল তার জীবনের যুদ্ধ। একই সাথে কৃতিত্বের সঙ্গে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং এবং এইচ.এস.সি পাশ করেন। এখানেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখলেন ।

এরপর তিনি বি.এস ইন নার্সিং এবং বি.এ পড়াশুনা শুরু করেন। সেখানেও তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। এরপর স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ থেকে মাস্টার্স অফ পাবলিক হেল্থ ( এম.পি.এইচ )এ কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন তার জীবনের শেষ ডিগ্রি নেওয়ার জন্য পি.এইচ.ডি এবং সেটাও কৃতিত্বের সঙ্গে সমাপ্ত করেন।

তার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৯৩ সালে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে। ২০১১ সাল হইতে তিনি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট নার্সিং কলেজের লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০২২ সালে তিনি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট নার্সিং কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ তিনি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট নার্সিং কলেজ এর ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে পদোন্নতি পান।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ১৯৯৫ সালের তার সংসার জীবন শুরু করেন । সংসার জীবনেও তিনি সফলতার মুখ দেখেছেন । তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তার ছেলে ও ছেলের বউ ইঞ্জিনিয়র এবং মেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত।তার স্বামী মোঃ নজরুল ইসলাম একটি গ্রুপ অব কোম্পানিতে কর্মরত আছেন ।

দক্ষতা প্রমাণ করেই আজকের অবস্থানে এসেছেন তিনি। আজকের অবস্থার জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, নিয়োগে যদি স্বচ্ছতা না থাকতো তাহলে আমি এ নিয়োগ পেতাম না । কারণ আমার কোন খুটির জোর নেই ।

নারী জাগরণের অগ্রপথিক বেগম রোকেয়ার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ঘরের মধ্যে রেখে কোনো জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। সমাজের সকল বৃত্ত ভেঙে নারী এগিয়ে যাবেই। অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে শুরু করে সমাজ বিনির্মাণেও অবদান রাখবে নারীরা।

তিনি আরও বলেন, আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষার আলো দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। সব মহীয়সী নারী, যারা আমাদের ভিত তৈরি করে দিয়েছেন, আওয়াজ তুলেছেন অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে, তাদের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমরা আজকের অবস্থানে এসেছি। বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে গেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর পদচারণা রয়েছে। তবে আরও অনেক দূর এগোতে হবে। নারীর মধ্যে অনেক রূপ রয়েছে। কেউ শিক্ষিত, কেউবা অশিক্ষিত। প্রতিবন্ধী নারীও আছেন। পাহাড়ি, আদিবাসী নারীও আছেন। তাই কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। তাদের ক্ষেত্রে কী কৌশল অবলম্বন করা যায়, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। নারীর উন্নয়ন করতে হলে সবার কথাই ভাবতে হবে। বাংলাদেশের লাখ লাখ নারী বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করেন না বলে পারিশ্রমিক পান না। তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ, তারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাচ্ছেন। এ সম্মানটা পরিবার থেকেই দিতে হবে। তাহলে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতাও কমতে থাকবে। ঘর থেকেই নারীর কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে।

লেখক
মোহাম্মদ মোক্তার হোসেন
সম্পাদক
crimevision.news

নিউজটি ভাল লাগলে শেয়ার দিন এবং আমাদের পেইজে লাইক দেয়ার অনুরোধ রইল ।

               

সর্বশেষ নিউজ