১৬, সেপ্টেম্বর, ২০২৪, সোমবার
     

মাফিয়ায় ছিন্নভিন্ন আর্থিক খাত

মাফিয়া চক্রের ভয়াল থাবায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে দেশের আর্থিক খাত। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজার—সর্বত্র দেদার চলেছে লুটপাট। দফায় দফায় লুটে নেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ। প্রতিটি ক্ষেত্রে লুটপাটকারীদের চেহারা উন্মোচিত হলেও বলতে গেলে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি সরকার। কারণ তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন ক্ষমতা কাঠামোর শক্তিশালী অংশীদার।

বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে দীর্ঘকাল ধরেই দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছিল। এই খাত সমস্যামুক্ত করতে ঋণ আদায়ে খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি ছিল। তা না করে বিগত সরকার লুটপাটের বহুমুখী সুযোগ তৈরি করে। পুরোনো ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা দূর না করে নতুন নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মূল যোগ্যতা ছিল দলীয় লোক হওয়া। মূলত অবৈধ উপায়ে আয় করা বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরির জন্য অনেকে ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়েছেন। সরকারও এসব অর্থের উৎস জানতে চায়নি। কালো টাকায় ব্যাংকের মালিক হয়ে পুরো ব্যাংকই

গ্রাস করে ফেলে কেউ কেউ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, জাতীয় অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড বা হার্ট হলো আর্থিক খাত। হৃৎপিণ্ড যেমন রক্ত পরিশোধন করে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সরবরাহের মাধ্যমে মানবদেহকে সচল রাখে, তেমনি আর্থিক খাতও বিভিন্ন খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দিয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখে। হৃৎপিণ্ডে রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক থাকলে যেমন শরীর ভালো থাকে, তেমনি ব্যাংক খাত ভালো থাকলে অর্থনীতিও ভালো থাকে। কিন্তু দেড় দশকের সীমাহীন লুটপাট দেশের আর্থিক খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে আর্থিক খাতে লুটপাটের দৃষ্টিভঙ্গি আগাগোড়াই ছিল। এস আলমের ছয়টি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। সালমান এফ রহমানের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে তুলে নেওয়া হয়েছে। যেগুলো এখন খেলাপি হয়ে গেছে। এই রকম আরও অনেক নজির আছে, যেখানে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সেখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেক অত্যন্ত কঠোরভাবে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।’

সর্বত্র বিরাজমান সালমান:

আর্থিক খাতে মাফিয়াতন্ত্রের মূলহোতা সালমান এফ রহমান। ব্যাংক, পুঁজিবাজার, বন্ড মার্কেট, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প-বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল তার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই আর্থিক খাতে যে কোনো নীতি প্রণয়নে হস্তক্ষেপ করতেন ‘দরবেশ’ অভিধায় পরিচিত সালমান। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রভাব খাটিয়ে নিজের এবং সহযোগীদের সুবিধামতো আইন ও বিধিবিধান তৈরি করাতেন।

২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল সরকার। কমিটির তদন্তে প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু, বুক-বিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রাথমিক শেয়ারের অতিমূল্যায়ন, সরাসরি তালিকাভুক্তি (ডিরেক্ট লিস্টিং), সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, অগ্রাধিকার (প্রেফারেন্স) শেয়ার, ব্যাংক ঋণকে শেয়ারে রূপান্তরসহ নানাভাবে বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রবণতা বন্ধে তাকে শেয়ারবাজার থেকে দূরে রাখার সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি।

তবে সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন দূরের কথা, উল্টো আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণে সালমান রহমানের ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়। ২০১৯ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা করা হয়। এতে ব্যাংক, পুঁজিবাজারসহ আর্থিক খাতের সর্বেসর্বা বনে যান সালমান। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ পদে নিয়োগ, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং আইন ও বিধিবিধান প্রণয়নে তিনিই ছিলেন মূল কারিগর। তার সুপারিশ ছাড়া ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ কিংবা বেসরকারি খাতে বড় বিনিয়োগের অনুমোদন পাওয়া কঠিন ছিল। প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নিজেও নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ ঋণ। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের পরিচিত কোম্পানির পাশাপাশি নামসর্বস্ব অনেক প্রতিষ্ঠানের নামেও নেওয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকারি-বেসরকারি সাতটি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে গত জুন পর্যন্ত শুধু জনতা ব্যাংকের পাওনা ছিল প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। নিজের মালিকানাধীন আইএফআইসি ব্যাংক থেকে বিভিন্ন কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছেন প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকে ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকে ৯৬৫ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে ১ হাজার ৪০৯ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকে ২ হাজার ৯৫২ কোটি ও এবি ব্যাংকে ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এর বাইরে রিজার্ভের অর্থে গঠিত রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে আড়াই কোটি ডলারেও বেশি ঋণ নিয়ে এখন পর্যন্ত ফেরত দেয়নি বেক্সিমকো গ্রুপের চার প্রতিষ্ঠান।

এসব ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর রউফ তালুকদার ও ফজলে কবিরের ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ করেছেন ব্যাংকাররা। শুধু তা-ই নয়, সালমান এফ রহমানসহ অনেককে খেলাপি তালিকার বাইরে রাখতে ঋণ পুনঃতপশিল নীতিমালা সহজ করেছেন তারা।

পুঁজিবাজারে সালমান এফ রহমানের জালিয়াতির বড় উদাহরণ জিএমজি এয়ারলাইন্স। ২০০৯ সালে এই কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। সেইসঙ্গে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয় ২৩০ কোটি টাকা। এরপর হঠাৎ জিএমজির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানি থেকে কোন টাকা ফেরত পাননি।

প্রকাশ্যে এত বড় জালিয়াতি করলেও সালমান রহমানকে কোনো জবাবদিহির মুখে পড়তে হয়নি। উল্টো শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের অনুমোদন পেয়েছেন বারবার। এর মধ্যে গত তিন বছরেই আনুষ্ঠানিকভাবে তুলেছেন সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। আর কারসাজির মাধ্যমে হাতিয়েছেন আরও প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে সালমানের সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তার আগের চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনও সালমানের কথার বাইরে যেতেন না বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

নজরুল ইসলাম মজুমদারের স্বেচ্ছাচার:

গত দেড় দশকে সালমান এফ রহমানের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক প্রভাবশালী ছিলেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও নাসা গ্রুপের কর্ণধার। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় পুরো মেয়াদেই তিনি বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান ছিলেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তার ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন তহবিল এবং সরকারের নানা আয়োজনে ব্যাংক থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন তিনি। সেই সুযোগে ব্যাংক ব্যবস্থাকে নিজের মতো ব্যবহার করেছেন। তার বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ক্ষমতার দাপটে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সীমার অতিরিক্ত শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন এই মজুমদার। সরকারি-বেসরকারি অন্তত ১৩টি ব্যাংকে নাসা গ্রুপ ও এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের ঋণ আছে। এর মধ্যে আটটি ব্যাংক থেকে সীমার অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে শত শত কোটি টাকা নগদে উত্তোলন করেছেন। যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে কমপক্ষে ২১০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব কাজে নিজের মালিকানাধীন এক্সিম ব্যাংককে ব্যবহার করেছেন।

ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট হলেও তা আড়াল করতে ভূমিকা রেখেছেন সালমান এফ রহমান ও নজরুল ইসলাম মজুমদার। তাদের ভূমিকার কারণেই বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যাংক মালিক, ব্যাংকার ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর না হয়েও উল্টো বিভিন্ন সময়ে সিআরআর কমানো, এক পরিবার থেকে চার পরিচালক নিয়োগ, সহজ শর্তে ঋণ পুনঃতফসিল করাসহ নানা সুবিধা দিয়েছে সরকার।

ব্যাংক দখল করে লুটেছে এস আলম:

গত এক দশকে ব্যাংকিং খাতে অভিনব কায়দায় লুটপাট চালিয়েছে আরেক মাফিয়া এস আলম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলম শুরুতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেন। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ইসলামী ব্যাংক দখল করে এস আলম গ্রুপ। এভাবে একে একে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এই গ্রুপ। এরপর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নেওয়া হয়।

ইসলামী ব্যাংক দখলের পর সাড়ে সাত বছরে

নামে-বেনামে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এস আলম ও তার সহযোগী অন্যান্য গ্রুপ, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশ। একইভাবে গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকের বেশিরভাগ ঋণ এই গ্রুপের কাছে আটকে আছে। বিপুল পরিমাণ টাকা বের হয়ে যাওয়ায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে এসআইবিএল, ফার্স্ট সিকিউরিটি এবং কমার্স ব্যাংক। শুধু নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, অন্য ব্যাংক থেকেও প্রভাব খাটিয়ে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের চট্টগ্রাম করপোরেট শাখার মোট বিতরণ করা ঋণের ৯০ শতাংশই এই গ্রুপের কাছে আটকে আছে।

দখল করা ব্যাংকগুলো ব্যবহার করে এস আলম বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

লুটপাটের জ্বলন্ত উদাহরণ ফারমার্স ব্যাংক:

ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে ব্যাংক লুটের বড় নজির তৈরি করেছেন ফারমার্স ব্যাংকের মালিকরা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীরকে এই ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছিল সরকার। কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যাংকটি থেকে কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকা লুটে নেন পরিচালকরা। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে ওই কেলেঙ্কারি ভুলিয়ে দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করা হয়। ‘পদ্মা ব্যাংক’ নাম দিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) থেকে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা জোগান দেওয়া হয়। জনগণের টাকায় ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট আরেক মাফিয়া চৌধুরী নাফিস সরাফতের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়।

সরাফতের থাবায় শেয়ারবাজার ও ব্যাংক:

সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে যুক্ত হন নাফিজ সরাফাত। রাষ্ট্রীয় বিশেষ সংস্থা ব্যবহার করে অল্প দিনের মধ্যেই সেখানে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত ৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ১০টিই তার প্রতিষ্ঠান রেইস-এর। এসব ফান্ডে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি ফান্ডের মেয়াদ শেষ হলেও বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেননি নাফিজ। প্রভাব খাটিয়ে কোনো কোনোটির মেয়াদ ১০ বছর বাড়িয়ে নেন।

জানা গেছে, বিএসইসির অনুমোদন না নিয়েই মিউচ্যুয়াল ফান্ডের টাকায় শেয়ার কিনে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন নাফিজ সরাফত। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জরিমানা মওকুফসহ বিভিন্ন ধরনের ছাড় পায় পদ্মা ব্যাংক। তা সত্ত্বেও ব্যাংকটির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত পদ্মা ব্যাংকের দেওয়া ৫ হাজার ৭৪০ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৩ হাজার ৫৫০ কোটি টাকাই ছিল খেলাপি।

অভিযোগ উঠেছে, পদ্মা ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা নিজের পকেটে ভরেছেন নাফিজ সরাফাত। ব্যাংকের আর্থিক হিসাবে ব্যাপক অসংগতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সমালোচনার মুখে গত ৩১ জানুয়ারি তিনি চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন। শেয়ারবাজারে অবৈধ বিনিয়োগ ও বেনামে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে নাফিজ সরাফতের অন্যতম সহযোগী ছিলেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ।

ধরাছোঁয়ার বাইরে বেসিক ব্যাংকের বাচ্চু:

ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের আরেক নজির বেসিক ব্যাংক। দীর্ঘদিন ধরে লাভজনকভাবেই চলছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানার এই ব্যাংক। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এরশাদ আমলের এমপি আবদুল হাই বাচ্চুকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে বসায়। এরপর থেকেই ঋণের নামে চলতে থাকে মহালুটপাট। বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি বাচ্চুর আশীর্বাদপুষ্টরা। কিন্তু এই ব্যক্তির টিকিটিও স্পর্শ করেনি সরকার।

বিভিন্ন গ্রুপের নামে লুট:

একইভাবে হলমার্ক, বিসমিল্লাহসহ বিভিন্ন গ্রুপের নামে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হলেও তা আর ফেরত আসেনি। একের পর এক ঋণ অনিয়মের কারণে ধ্বংসের দ্বারে পৌঁছেছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। কৃষি, বিডিবিএল এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে মোট ঋণের অর্ধেকের বেশি খেলাপি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এবি ব্যাংক থেকে সিঙ্গাপুরে পাচার হয়ে গেছে ২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। নাজুক অবস্থায় পড়েছে ইউসিবিএল, ন্যাশনাল ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক।

ব্যাপক লুটপাট ও অব্যবস্থাপনার ফলে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মাত্র দুবছর আগে যেখানে খেলাপি ঋণ ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা; সেখানে গত মার্চ মাস পর্যন্ত তা দাঁড়ায় ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। অবলোপনের নামে হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে আরও প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ ঋণ অনাদায়ী থাকায় ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।

সার্বিক বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ কালবেলোকে বলেন, ‘গত ১৫ বছরে দেশের পুরো অর্থনীতি চলে গেছে মাফিয়াদের হাতে। এই মাফিয়া গোষ্ঠী ছিল বিগত সরকারের খুব কাছের মানুষজন। কারণ সরকারের সমর্থন ছাড়া তো কেউ মাফিয়া হতে পারে না। সরকার এদের লালন-পালন করেছে। কারণ এদের

ভাগবাটোয়ারা দিয়েই সরকার দেশ পরিচালনা করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংক, পুঁজিবাজার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যারা অর্থ লোপাট করেছে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’

               

সর্বশেষ নিউজ