১৬, সেপ্টেম্বর, ২০২৪, সোমবার
     

কেন যৌথ অভিযান, কীভাবে পরিচালিত হবে?

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও সহিংস ছাত্র-জনতার এক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট পতন হয় স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের। পতনের পরপরই দেশজুড়ে পাঁচ শতাধিক থানায় হামলা চালিয়ে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়। এর মধ্যে গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত তিন হাজার ৮৮০টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ সদর দপ্তর। তবে বেশির ভাগ অস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি।

এদিকে এসব অবৈধ অস্ত্রের সঙ্গে যোগ হয়েছে গত ১৫ বছরে বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রও। যার বেশির ভাগই রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে।

এসব অস্ত্র মঙ্গলবারের মধ্যে গোলাবারুদসহ এসব আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু এই নির্দেশে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। যার ফলে দেশে হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, অপহরণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের শঙ্কা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আগামী বুধবার থেকে সারা দেশে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

তবে থানাগুলো থেকে কি পরিমাণ অস্ত্র লুট হয়েছে সে বিষয়ে পরিসংখ্যান মঙ্গলবারের পর জানানো হবে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এখন প্রশ্ন হলো কাদের কাছে রয়েছে এসব অবৈধ অস্ত্র? কীভাবে এই অভিযান পরিচালনা করবে যৌথ বাহিনী?

কেন এই অভিযান?
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন সময়েই বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার দেখা গেছে।
বিরোধীপক্ষকে শায়েস্তা করতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অস্ত্রের প্রদর্শন করতেও দেখা গেছে। এসব ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয়। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে সময় ছড়িয়ে পড়ে।

এসব ভিডিওতে তাদেরকে কখনও পুলিশের সামনে আবার কখনও নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলনকারীদের দমাতে অস্ত্র হাতে দেখা গিয়েছে। এ আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে তিন দিন রাজধানীসহ দেশজুড়ে প্রায় পাঁচশ থানায় হামলা হয়। লুটপাট করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা ও পুলিশের যানবাহন। এসব ঘটনায় পুলিশের প্রায় সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

তবে পরবর্তীতে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সব থানার কার্যক্রম শুরু হয়। তবে পুলিশ এখনও পুরোপুরি কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।
দেশের গণমাধ্যমগুলোতে বলা হয়েছে, দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কমবেশি ৫০ হাজার। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হাতে দশ হাজারের বেশি অস্ত্র রয়েছে। এদের বড় অংশই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। যা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের সময়ে এদের অনেকেই অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। তবে এসব অস্ত্রগুলোর লাইসেন্স গত ২৫ আগস্ট স্থগিত করে দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

এছাড়া পুলিশ সদর দপ্তর থেকে গত ২৭ শে আগস্ট থানা থেকে লুট হওয়া পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেওয়ার সময়ও বেধে দেয়।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বলা হয়, কোনো ব্যক্তির কাছে এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকলে মঙ্গলবারের মধ্যে নিকটস্থ থানায় জমা দিতে হবে। এ সময়ের মধ্যে কেউ এসব লুণ্ঠিত অস্ত্র জমা না দিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানানো হয়।
কত অস্ত্র লুট এবং উদ্ধারকৃত অস্ত্রের পরিসংখ্যান

পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া এবং পাবলিক রিলেশন বিভাগের এআইজি এনামুল হক সাগর গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সারাদেশের থানাগুলো থেকে কত অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে, তা মঙ্গলবারের পর জানানো হবে।

তিনি জানান, সম্প্রতি অস্ত্র ও গোলাবরুদ যেগুলো লুণ্ঠিত হয়েছে, এ তথ্যটি আমরা প্রায় শেষ পর্যায়ে আছি। তিন তারিখে জমা দেওয়ার ডেডলাইন রয়েছে, সেটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে সেটা (কত অস্ত্র লুট) জানিয়ে দেওয়া হবে।

এরই মধ্যে পুলিশের লুণ্ঠিত বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে বলেও জানান তিনি।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রতিদিন লুণ্ঠিত এসব অস্ত্র উদ্ধারের পরিসংখ্যান জানানো হয়।

এআইজি এনামুল হক সাগর আরও জানান, পহেলা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের তিন হাজার ৮৮০ টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গোলাবারুদের মধ্যে দুই লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৩ রাউন্ড গুলি, বাইশ হাজার ২০১ টি টিয়ার গ্যাসের সেল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া লুণ্ঠিত দুই হাজার ১৩৯ টি সাউন্ড গ্রেনেডও উদ্ধার হয়েছে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, শুধু রাজধানীর বিভিন্ন থানা থেকে এক হাজার ৮৯৮টি অস্ত্র লুট করা হয়। এর মধ্যে গত ২৪ শে আগস্ট পর্যন্ত ৪৫৩ টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি এক হাজার ৪৪৫টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয় নি। এরই মধ্যে রোববার নাটোরে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি বিদেশি পিস্তলসহ এগারো রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে পুলিশ।

নাটোরের পুলিশ সুপার মো. মারুফাত হোসাইন গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, গতকাল রাতে ব্রাজিলের তৈরি একটি সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ অবৈধ পিস্তল উদ্ধার করেছি। দুইটি ম্যাগাজিন ও এগারো রাউন্ড গুলিও উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তদন্তে পাচ্ছি একজনের নামে লাইসেন্সকৃত। আশফাকুল ইসলাম নামে এক লোকের নামে এই পিস্তল লাইসেন্সকৃত। কিন্তু ওই পিস্তলের সাথে ৫০ রাউন্ড গুলি ছিল। কিন্তু আমরা পেয়েছি এগার রাউন্ড। তার বাসার কাছে এটি পাওয়া গেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই ব্যক্তি পলাতক রয়েছে। এ বিষয়ে জিডি করার পর তদন্ত চলছে। তদন্তে যা পাওয়া যাবে সেই আলোকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আশফাকুল ইসলামের বিরুদ্ধে গত পাঁচই আগস্ট ছাত্র –জনতার ওপর গুলি করার অভিযোগ রয়েছে। পিস্তল হারিয়ে গেছে জানিয়ে গত ১৪ আগস্ট থানায় ই-মেইল করেছিলেন তিনি।।

মঙ্গলবার পর্যন্ত লাইসেন্স স্থগিত যাদের করা হয়েছে এমন অস্ত্র জমা দেওয়ার সময় রয়েছে জানিয়ে এআইজি এনামুল বলেন, আজকে পর্যন্ত ৩৫ টি অস্ত্র জমা পড়েছে। ১১৬৯ রাউন্ড গুলি জমা পড়েছে। এগুলো সব লাইসেন্সকৃত অস্ত্র।

কীভাবে অভিযান পরিচালনা করা হবে?

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, স্থগিত করা লাইসেন্সের বিপরীতে থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ থানায় জমা না দিলে উদ্ধার অভিযানে সেগুলো জব্দ করা হবে। একই সঙ্গে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেহাত হওয়া ও হারানো অস্ত্রসহ যে কোনো অবৈধ অস্ত্র এ অভিযানে উদ্ধার করা হবে।

সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, র‍্যাব ও আনসারের যৌথ সমন্বয়ে অপারেশন টিম গঠন করে অভিযান পরিচালনা করা হবে। তবে মহানগর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করবেন পুলিশ কমিশনার। সব বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় কমিশনার এ অভিযান পরিচালনা করবেন।

জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কোর কমিটির মাধ্যমে স্থগিত করা লাইসেন্সের তালিকা পর্যালোচনার ভিত্তিতে অভিযান পরিচালিত হবে। এই কমিটিতে পুলিশ সুপার, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন।

এছাড়া অবৈধ অস্ত্র সংরক্ষণ বা হেফাজতকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি জেলা তথ্য অফিস প্রচার করবে।

অভিযান ফলপ্রসূ হবে কি?

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি এনামুল হক সাগর বলেন, প্রজ্ঞাপনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে তিন তারিখের পরে কিন্তু সেগুলো অবৈধ অস্ত্র হিসেবে গণ্য হবে এবং অস্ত্র আইনে কিন্তু মামলা রুজু হবে। আপনাদের মাধ্যমে আহ্বান জানাতে চাই তিন তারিখের মধ্যে যাতে সকলে সব অস্ত্র জমা প্রদান করে।

কাদের হাতে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে এআইজি এনামুল হক জানান, অবৈধ অস্ত্র এবং গোলাবারুদ উদ্ধারে একেবারেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

তিনি বলেন, উদ্ধারে যে যৌথ অভিযান পরিচালনা হবে সেটাতেও আশা করছি একটি ভালো রিকভারি আমাদের হবে। বেশ আশাবাদী আমরা, যে যৌথ অভিযানে আমাদের বাহিনীগুলোর মধ্যে একটা সুসমন্বয়ের মাধ্যমে সেই জায়গাতে পৌঁছতে পারবো।

লুণ্ঠিত ও অবৈধ অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ ও নিরাপত্তার আশঙ্কার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন পুলিশ সদর দপ্তরের এ কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, আমরা নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করতে চাই। যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর কোনো কিছু যেন কখনো সংগঠিত না হয় সেজন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আর অস্ত্র, গোলাবারুদ যেগুলো এখনো মিসিং রয়েছে সেগুলোতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উদ্ধারের জন্য আমরা চেষ্টা করছি এবং করবো।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

               

সর্বশেষ নিউজ