ডলার কারসাজির সঙ্গে জড়িত চক্র বা হোতাদের একটি অংশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি তাদের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে তিনটি মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া একই অভিযোগে আরও ২টি মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠনের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। এ বিষয়ে আজ-কালের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দেওয়া হবে। লাইসেন্স ছাড়া মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায় করায় ১১টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, যে তিনটি মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে-রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকার বিসমিল্লাহ মানি চেঞ্জার্স, নয়াপল্টনের ফয়েজ মানি এক্সচেঞ্জ ও পুরানা পল্টনের অংকন মানি চেঞ্জার্স লিমিটেড।
সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে তদন্ত করে। তারা প্রতিষ্ঠানগুলোর ডলার বিক্রি ও কেনার তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো পর্যালোচনা করে ওই ৩টি প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের অনিয়ম পেয়েছে। এ কারণে তাদের সব ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থগিত করেছে। বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্য কেন তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে না এ মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধিবহির্ভূতভাবে ডলার কিনে তা খোলাবাজারে বিক্রি এবং ডলার মজুতের তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও বিশদ তদন্ত করছে।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। লাইসেন্স ছাড়া এ ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে ১১টি মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানের কোনো লাইসেন্স পাওয়া যায়নি। এসব প্রতিষ্ঠান কোনো লাইসেন্স ছাড়াই বেআইনিভাবে মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা করে আসছিল। যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ওইসব প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো লাইসেন্স নেই, সেই কারণে এদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের তালিকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে বেআইনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, লাইসেন্স ছাড়া মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা করার দায়ে ওইসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলাও করা হবে।
এদিকে গোয়েন্দারা বাজার থেকে বেআইনিভাবে ডলার কিনে যারা মজুত করেছেন তাদের খুঁজছেন। এজন্য মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠান থেকে ডলার কেনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকাও সংগ্রহ করেছেন।
এছাড়া ডলার মজুত ও বেআইনিভাবে কেনাবেচার দায়ে আরও ২টি মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে আজ-কালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হবে।
বাজারে ডলার ছাড়তে শুরু করেছেন মুজতদাররা : বাংলাদেশ ব্যাংক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদারকিতে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। বাড়তি মুনাফার আশায় যারা বেআইনিভাবে ডলার মজুত করেছিলেন, তারা এখন সেগুলো বিক্রি করতে শুরু করেছেন। ফলে ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানগুলোয় ডলারের প্রবাহ বেড়ে গেছে। দামও কিছুটা কমে এসেছে। খোলাবাজারের ডলার ব্যাংকমুখী করতে ব্যাংক ও খোলাবাজারের মধ্যকার ডলারের দামের ব্যবধান বেশ কমেছে। আগে যেখানে ব্যবধান ছিল ১০ টাকা, এখন ১ টাকায় নেমে এসেছে।
সূত্র জানায়, সোমবার ব্যাংকগুলো নগদ ডলার কিনেছে সর্বোচ্চ ১০৫ টাকা দরে। তবে অনেক ব্যাংক ১০০ টাকা থেকে ১০৪ টাকার মধ্যে ডলার কিনেছে। মানি চেঞ্জার্স ও খোলাবাজারের ব্যবসায়ীরা ডলার কিনেছেন ১০৬ টাকা করে। এ হিসাবে সর্বোচ্চ মূল্যে ডলারের দামের ব্যবধান ১ টাকায় নেমে এসেছে। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলো নগদ ডলার কিনছে ১০৫ টাকা করে। সেগুলো তারা বিক্রি করছে ১০৭ টাকা করে। খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১০৮ টাকা করে।
এর আগে বাজারে ডলার সংকটের অজুহাতে ব্যাংকে দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকায় ওঠে। খোলাবাজারে ওঠে ১১২ টাকায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানগুলোয় এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খোলাবাজারে তদন্ত শুরু করলে ডলারের দাম কমতে থাকে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
সংকটের কারণে ডলারের দাম আরও বাড়তে পারে-এমন প্রত্যাশা থেকে অনেকেই ডলার মজুত করতে শুরু করে। বেআইনিভাবে ব্যাংক ও খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে সেগুলো নিজেদের কাছে মজুত করে রাখে। এতে বাজারে ডলারের সংকট দেখা দেয়। ফলে বাজারে খোলাবাজারে ডলারের দাম হুহু করে বেড়ে যায়।
সোমবার মতিঝিল ও গুলশান এলাকার মানিচেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেকেই এখন ডলার বিক্রি করছেন। মতিঝিল দিলকুশা এলাকায় কয়েকটি মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানেও অনেক বিক্রেতাকে দেখা গেছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল মানি চেঞ্জার্স ও ব্যাংকগুলোয় গত মে থেকে জুলাই পর্যন্ত কারা ডলার বিক্রি করেছেন এবং কিনেছেন, তা পর্যালোচনা করছে। যারা ডলার বিক্রি করেছেন, তারা কোত্থেকে পেলেন এবং যারা কিনেছেন, তারা কী জন্য কিনেছেন-এসব তথ্য অনুসন্ধান করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তালিকাও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে দেওয়া হয়েছে। সে তালিকা ধরে তারা তদন্ত করছে। তবে বেশকিছু অবৈধ মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সেগুলোয় তারা নজরদারি বাড়িয়েছেন।
এর আগে কয়েকজন ব্যাংকার বলেছেন, কতিপয় ব্যাংক, মানি চেঞ্জার্স ও খোলাবাজারের ব্যবসায়ী বেআইনিভাবে ডলার মজুত করায় বাজারে সংকট প্রকট হয়েছে।
সোমবারও ব্যাংকগুলোয় আমদানির জন্য ডলারের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এখন ৯৪ টাকা ৭৫ পয়সা দরে বিক্রি হচ্ছে। আন্তঃব্যাংকেও প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ইউরো : ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরো আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। প্রায় এক সপ্তাহ ডলারের নিচে ছিল ইউরোর দাম। এখন ডলারকে ছাড়িয়ে গেছে ইউরো। ব্যাংকগুলোয় প্রতি ইউরো বিক্রি হচ্ছে ৯৮ টাকা দরে। ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯৪ টাকা ৭৫ পয়সা দরে। নগদ ডলারের চেয়েও ইউরোর দাম বেশি। নগদ ডলার ১০০ থেকে ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইউরো বিক্রি হচ্ছে ১০৮ টাকা করে।
গত সপ্তাহে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইউরোর সুদের হার দশমিক ১৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। ফলে ইউরোর দাম বাড়তে শুরু করেছে। এদিকে ডলারের চেয়ে ইউরোর দাম কম হওয়ায় এর চাহিদাও বেড়েছে। অনেকেই এখন বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে ডলারের পরিবর্তে ইউরো নিয়ে যাচ্ছেন।