২৬, ডিসেম্বর, ২০২৪, বৃহস্পতিবার
     

বিপর্যয়ের আশঙ্কা কৃষি উৎপাদনে

সারের দাম বৃদ্ধির ৪ দিনের মধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে এক লাফেই ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। আর সারের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৮ শতাংশ। কৃষি উৎপাদনের সবচেয়ে মৌলিক দুটি পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে এখাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদসহ এ খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এবার বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত অনেক কম। এতে স্বাভাবিকের চেয়ে সেচ বেশি লাগছে। কিন্তু ডিজেলের দাম বাড়ানোয় খরচ অনেক বেড়ে যাবে। বাড়বে পরিবহণ ভাড়া। আর এমন এক সময়ে সরকার এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিল যখন আমন মৌসুমের ফসল বোনা লাগানো শুরু হয়েছে। ফলে এ মৌসুমে প্রতিটি কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। অনেক কৃষক জমির আবাদ কমিয়ে দেবেন। সামগ্রিকভাবে যা দেশের মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্যের হার বাড়িয়ে দেবে।

শুক্রবার রাত থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৮০ টাকা থেকে ১১৪, অকটেনের দাম ৮৯ থেকে ১৩৫ এবং পেট্রোলের দাম ৮৬ থেকে ১৩০ টাকা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ডিজেলে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ, অকটেনে ৫১ দশমিক ৬৯ এবং পেট্রোলের দাম ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর আগে ১ আগস্ট প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের দাম ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২২ টাকা করা হয়েছে। শতকরা হিসাবে যা ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, নতুন এ সিদ্ধান্তে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কৃষি ও শিল্পোৎপাদন কমে যাবে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন কমবে। সবশেষে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। ডিজেল ও সার এ দুটিই কৃষির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আর দুটি পণ্যের দাম বাড়ানোয় এ খাতের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। ডিজেলের কারণে সেচ ও পরিবহণ খরচ বাড়বে। এরপর সারের কারণে আরও বাড়বে খরচ। ফলে এ খাতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। মির্জ্জা আজিজ বলেন, এমনিতেই বর্তমানে আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি। এরপর উৎপাদন ব্যয় বাড়লে তা পুরো অর্থনীতিতে সংকট তৈরি করবে। বিশেষ করে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ ও প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর বড় আঘাত আসবে।

এদিকে কৃষকরা বলছেন, চলতি আমন মৌসুমে উৎপাদন ব্যয় উঠবে কিনা-তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বেশি সমস্যায় বর্গাচাষিরা। তারা বলছেন, সারের দাম বৃদ্ধি এবং অনাবৃষ্টিসহ শ্রমিক ব্যয় ও আনুষঙ্গিক যে ব্যয় হবে, তাতে চলতি মৌসুমে আমন চাষে লোকসান হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। এক্ষেত্রে সব সময়ই ভর্তুকি কমাতে আইএমএফের চাপ থাকে। তাই পণ্য দুটির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অনাবৃষ্টি, সার ও তেলের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে খুলনাঞ্চলের কৃষকরা। এ বছর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খরা চলছে। ভরা বর্ষা মৌসুমেও বৃষ্টির দেখা নেই। মানুষ বিকল্প হিসাবে সেচের মাধ্যমে ধান চাষের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে সার ও তেলের দাম বৃদ্ধিতে খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, জেলা এবার ৯৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এজন্য প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে অনাবৃষ্টির কারণে এখন পর্যন্ত সাড়ে তিনশ হেক্টর জমিতে সেচের মাধ্যমে বীজতলা তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে মৌসুমের শুরুতেই সারের দাম বাড়ানো হয় কেজিতে ৬ টাকা। একদিকে চাষের খরচ বাড়ছে। অন্যদিকে আবার সেচের জন্য তেলেরও দাম বাড়ানো হয়েছে। উভয় দিক মিলিয়ে সংকটে পড়েছে কৃষকরা।

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কৃষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন-আবহাওয়া ঠিক থাকলে বর্ষায় এক বিঘা জমিতে ধান চাষে সাধারণত খরচ হয় ৪ হাজার ৫০০ টাকা। ধান উৎপাদন হয় ৮ হাজার টাকার মতো। এ বছর সারের দাম বেড়েছে। উপরন্তু বৃষ্টি নেই। এরপর সেচ কাজে ব্যবহৃত জ্বালানির দামও বাড়ানো হয়েছে। খরচ ওঠানোই দায়। শার্শা উপজেলার শালকোনা গ্রামের সাহেব আলী জানান, একে তো বৃষ্টির অভাবে আমরা রোপা আমন লাগাতে পারছি না। সেচ খরচ বেশি হচ্ছে, তার ওপর সরকার ইউরিয়া সারে কেজিতে ৬ টাকা বাড়িয়েছে। তবে আমাদের এখানে খুচরা পর্যায়ে ২৫ থেকে ২৬ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এতে আমন উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। ঝিকরগাছা উপজেলার মাটিকুমড়া গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা জানান, আমরা সবেমাত্র রোপা আমন বপনের কাজ শুরু করেছি। বৃষ্টির অভাবে সেচ দিয়েই চাষ শুরু করেছি। সারের পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সেচ খরচও বেড়ে যাবে। কৃষকরা বাড়তি চাপে পড়বে। কৃষি উৎপাদনও কমবে। মূলত আমন ধান বৃষ্টি নির্ভর। এবার বৃষ্টি না থাকায় সেচ নির্ভর হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রাম লোহাগাড়া উপজেলার আলী আহমদ নামে এক প্রান্তিক কৃষক যুগান্তরকে বলেন, ৪০ শতক জমিতে ধান উৎপাদনে সেচ, ট্রাক্টর খরচ ও শ্রমিকের মজুরিসহ আগে খরচ পড়ত চার হাজার টাকা থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে সার ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে খরচ দ্বিগুণের কাছাকাছি হবে। এ অবস্থায় উৎপাদনের সঙ্গে খরচের সামঞ্জস্য থাকবে না। যার কারণে কৃষকরা চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। একই এলাকার সার পৌঁছানো ডিলার আবদুল মান্নান মান্না যুগান্তরকে বলেন, সার পরিবহণেও নানা অনিয়ম রয়েছে। লাখ লাখ টন সার মাঝপথে গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। তাই প্রতি ভরা মৌসুমে সারের জন্য কৃষকদের মধ্যে প্রায় হাহাকার লেগে থাকে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও দাম বাড়ানো হয়। পরিবহণ ঘাপলা, কৃত্রিম সংকটসহ সার নিয়ে সব ধরনের অনিয়মে অরাজকতার মূল্য দিতে হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকদের। এ কারণে প্রান্তিক কৃষকরা উৎপাদন বিমুখ হয়ে পড়ছেন।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছে যুগান্তরের চট্টগ্রাম, খুলনা ও যশোর ব্যুরো।-যুগান্তর

               

সর্বশেষ নিউজ