২৬, এপ্রিল, ২০২৪, শুক্রবার
     

আলুচাষিদের মাথায় হাত, কৃষক পান ৫ টাকা, ঢাকায় কেজি ২০

গত বছর আলু মৌসুমে মোটামুটি দাম পেয়েছিলেন কৃষকরা। তবে, পরবর্তী সময়ে কোল্ড স্টোরেজে রাখা আলুর নায্য দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। কোল্ড স্টোরেজে দীর্ঘ দিন ভাড়া দিয়ে রেখে প্রতি কেজি আলু তখন ১১-১২ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা। অথচ সবমিলিয়ে প্রতি কেজি আলুর খরচ পড়েছিল ১৭-১৮ টাকা। সেই আলু তখন ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হয় খুচরা বাজারে। দামে বঞ্চিত হন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

এবার গোল আলু তোলার ভরা মৌসুমে ফের মার খাচ্ছেন চাষিরা। আলু চাষ করে যেন বিপাকেই পড়েছেন তারা। উৎপাদন অনেকটা ভালো হলেও লাভ তো দূরের কথা, খরচই উঠছে না তাদের। মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, দিনাজপুরসহ আলু আবাদসমৃদ্ধ জেলাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয়ভাবে পাঁচ-সাত টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করছেন কৃষকরা। বিঘাপ্রতি কয়েক হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। অথচ পাঁচ-সাত টাকা কেজির আলু ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ১৮-২০ টাকায়। মাঝখানে ১০-১২ টাকা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীসহ বিভিন্ন মহলের পকেটে। মুন্সীগঞ্জের চাষি জাহাঙ্গীর কাজী নয়া দিগন্তকে বলেন, এবার আলুতে অনেক লসে আছি। ক্ষেত থেকে সাত টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। আর কিছুদিন আগে এটা পাঁচ টাকায়ও বিক্রি করেছি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে গোল আলুর চাহিদা ৮৫-৯০ লাখ মেট্রিক টন। গত (২০২১) মৌসুমে উৎপাদন হয় এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার চেয়ে ২০-২৫ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হওয়ায় তখন কোল্ড স্টোরেজে রাখা আলু নিয়ে বিপাকে পড়েন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত উপপরিচালক (কন্ট্রোল রুম) খন্দকার মু: রাশেদ ইফতেখার জানান, এবার মোট চার লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে গোল আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও হয়েছে চার লাখ ৮৭ হাজার হেক্টরে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় এক কোটি ছয় লাখ ৫১ হাজার টন। আলুর আবাদ ভালো হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪০ শতাংশ জমির আলু হার্ভেস্ট হয়েছে।

বগুড়া থেকে সংবাদদাতা আবুল কালাম আজাদ জানান, এবারো দাম নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বগুড়াসহ চার জেলার আলুচাষিরা। ভরা মৌসুমে কাক্সিক্ষত দাম না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা। তবে গত বছরের মজুদ শেষ হলে দাম কিছুটা বাড়ার আশা করছেন চাষিরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি রবি মৌসুমে বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় এক লাখ দুই হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও চাষ হয়েছে এক লাখ এক হাজার ৮১ হেক্টর। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৯ মেট্রিক টন। এই চার জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে বগুড়া জেলায় ৫৭ হাজার ৭০৫ হেক্টর। এর পরে জয়পুরহাট জেলায় ৪০ হাজার ২৮০ হেক্টর, পাবনা জেলায় মাত্র ৯১১ হেক্টর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় দুই হাজার ৯১৫ হেক্টর। সূত্র জানায়, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বগুড়া জেলায় ৩০ হাজার ৪৭০ হেক্টর ও জয়পুরহাটে ২১ হাজার ৭৫০ হেক্টরের জমির আলু কর্তন বা জমি থেকে উত্তোলন করা হয়েছে।

কৃষি বিভাগ জানায়, বগুড়ার মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। মুন্সীগঞ্জের পরেই আলু চাষে বগুড়ার অবস্থান। সে হিসাবে দেশে আলু উৎপাদনে বগুড়ার অবস্থান দ্বিতীয়। তাই স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে অন্য জেলাতে সরবরাহ করা হয়। সাধারণত মাটিতে একবার আলু রোপণ করলে একবার ফলন পাওয়া যায়; কিন্তু এবারের চিত্র ছিল ভিন্ন। চাষিরা এবার দুইবার আলু রোপণ করে ফলন পাচ্ছেন মাত্র একবার। সে কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়া বাজারের অবস্থা ভালো না থাকায় লোকসানে পড়েছেন চাষিরা। এবার আগাম আলু রোপণের কয়েক দিন পরেই বৃষ্টি হয়। তাই রোপণকৃত আলু মাঠেই পচে যায়। আবারো লাভের আশায় সেই জমিতে আলু রোপণ করেন চাষিরা।

বগুড়া জেলায় প্রতি মণ আলু বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা দরে। তবুও মাঠে ক্রেতা নেই। উৎপাদিত আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। লাভের আশায় আগাম আলু চাষে ঝুঁকেছিলেন তারা; কিন্তু আগাম আলুর বাজারে ধস নামায় লোকসান হচ্ছে। গত বছর চাষিরা এই সময় প্রতি মণ আলু মাঠেই বিক্রি করেছিলেন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরে। আর এবার সেই আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২০০ থেকে আড়াই শ’ টাকা মণ দরে। বগুড়া শহরের পাইকারি রাজাবাজারে প্রতি পাঁচ কেজি (হল্যান্ড) কাটি লাল আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা এবং লাল পাকড়ি প্রতি পাঁচ কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকা।

শিবগঞ্জ সংবাদদাতা খলিলুর রহমান আকন্দ জানান, বর্তমান বাজারদরে আলু বিক্রি করে প্রতি হেক্টরে (২৪৭ শতক) চাষিরা দাম পাচ্ছেন ৯০-৯৫ হাজার টাকা। আর প্রতি হেক্টর আলুর উৎপাদন খরচ হয় প্রায় দুই লাখ টাকা। গত বছর জেলায় ৬৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছিল ১৪ লাখ ৪১ হাজার ২৯৭ মেট্রিক টন। কৃষি বিভাগ বলছে, গত বছরের কিছু আলু মজুদ থাকায় বাজারদর কম। পুরাতন আলু শেষ হলে দাম কিছুটা বাড়তে পারে। বর্তমানে শিবগঞ্জ উপজেলায় সাদা আলু পাইকারি পাঁচ টাকা ও লাল আলু ৯-১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। উপজেলার কিচক এলাকার আলুচাষি রমজান আলী বলেন, ‘গত বছর আলুর দাম বেশি ছিল, ফলে কম ফলনেও ভালো লাভ হয়েছিল। এবার বেশি ফলনেও লোকসান হচ্ছে। লাভ তো দূরের কথা, আসলও তুলতে পারছি না। কম দামে আলু বিক্রি করে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে।

তার পরেও নগদ টাকার ক্রেতা নেই।’ উপজেলার মোকামতলা এলাকার আরেক আলুচাষি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘সাড়ে চার একর জমিতে আলু চাষ করেছিলাম। খরচ হয়েছে প্রায় চার লাখ টাকা। ছয় টাকা দরে আলু বিক্রি করে দাম পাচ্ছি দুই লাখ টাকা। এই টাকায় লাভ তো নয়, আসল টাকাও আসেনি। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, গত বছরের বাড়তি আলুর মজুদ শেষে হলে বাজারের অবস্থা ভালো হবে। সেই সাথে আলুর ফলন ভালো হলে চাষিদের লোকসান পুষিয়ে যাবে।

দিনাজপুর সংবাদদাতা সাদাকাত আলী খান জানান, চলতি মৌসুুমে দিনাজপুরে ৪৭ হাজার ৩৯০ হেক্টর জমিতে আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার ১৭৫ মেট্রিক টন। দিনাজপুর কৃষি বিভাগ জানায়, গত বছর দাম কমে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এবার কম আলু আবাদ হয়েছে। জেলায় প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১২ টাকা। অথচ বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা কেজি দরে। চলতি মৌসুমে দিনাজপুরে প্রতি বিঘা জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছে ৭৫ মণ। উৎপাদন ভালো হওয়ায় লাভের আশা করছিলেন চাষিরা; কিন্তু বাজারে দর কমে যাওয়ায় লোকসান আশঙ্কায় তারা। আলুতে গত বছর লোকসান হওয়ায় এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ কম হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

দিনাজপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যুগ্ম পরিচালক প্রদীপ কুমার গুহ বলেন, এবারের আবহাওয়া আলু চাষের জন্য অনুকূলে রয়েছে। অন্যান্য সময়ে আগাম আলুর বাজারে কৃষকরা ন্যায্য দাম পেয়েছেন। তবে এবার তা নিশ্চিত হয়নি। দাম নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে কৃষকরা বলেন, অবস্থা অনেক খারাপ। আলু বেচা যায় না। আলু তিন থেকে চার টাকা কেজি বিক্রি হলে কৃষকের কোনো লাভ হবে না। এক বিঘা জমিতে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আলু বিক্রি করে আমাদের কিবা উন্নতি হবে। এখন সরকার যদি আমাদের আলু রফতানির সুযোগ করে দেয়, তাহলে আমাদের জন্য ভালো হয়।

               

সর্বশেষ নিউজ