মো. আজিজার রহমান, খানসামা, (দিনাজপুর) প্রতিনিধি: দিনাজপুরের খানসামা উপজেলায় খুন গুম ধর্ষণ অনাকাঙ্ক্ষিত লাশের আতঙ্কে খানসামাউপজেলার সাধারণ জনগণ। সাম্প্রতিক সময়ে খানসামা উপজেলায় বেশকিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটছে যা সত্যি অবাক করার মত। গত ১০ থেকে ২ আগষ্ট পর্যন্ত ১৪ জনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয়েছে। আত্রাই নদীতে ডুবে ৩, পানিতে ২, আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন, সড়ক দুর্ঘটনায় ১ জন বিদ্যুৎস্পর্শে ২জন এবং ১ দিনে ২জন নারী ও ১ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঐ তিন পরিবারের দাবী এগুলো পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। এমনকি অবুঝ শিশু বিপাশাকে হত্যা উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে পাষণ্ডরা। এছাড়াও মার্চ ২০২০, খানসামা ডিগ্রি কলেজের পিছনে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আঞ্জুয়ারাকে গণধর্ষণ এবং হত্যা, বিচারের বানী প্রশাসনের টেবিলের নিচেই আজো কাঁদে!
২০২১ এ জোয়ারের লতা রানীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে গণধর্ষণ এবং নির্মম হত্যাকাণ্ড। এটার বিচারের কাহিনী, পুলিশ নাম মাত্র একজনকে গ্রেফতার করেছেন। আরো রয়েছে অজানা অনেক কিছু। অসহায় অপো রাণী রায়, সাদেকা বেগম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আঞ্জুয়ারা ও লতা রানী। ছোটাছুটি করছে রাস্তায়, পাগলের মতো। গগন বিদারী আর্তনাদ কণ্ঠে। পাশে চিৎকার করে আকুতি জানাচ্ছে অবুঝ শিশু বিপাশা। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অমানুষদের কাছে, যাদের মাঝে ছিল ধর্ষণের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। কেউ এগিয়ে আসছে না। চোখের সামনে মায়ের সম্ভ্রমহানি হচ্ছে, মেয়েটির মমতাময়ী মা। আপ্রাণ চেষ্টা করছে মেয়েটি সেদিন বাঁচাতে পারেনি আর্তনাদকারী মাকে। কেউ এগিয়ে এলো না। নির্মমভাবে ধর্ষণ করে তাকে মৃতাবস্থায় রেখে চলে গেল অজ্ঞানকৃত অবুঝ শিশু বিপাশা’র সামনে দিয়ে, প্রবল দাপটে।
কি অপরাধ ছিল অপো রাণী রায়, সাদেকা বেগম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আঞ্জুয়ারা ও লতা রানী’র ! যার কারণে লাশে পরিনত হলেন তারা ?
অথচ গত ২৯ তারিখে সাদেকা বেগমের রহস্যজনক মৃত্যু বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পিছনে দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা ধান্দা দিয়েও কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জনপ্রতিনিধিরা বক্তব্য দিতে নারাজ।
আমাদের সমাজে ধর্ষণ, মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী ও লম্পট হিসেবে পরিচিত অনেক মামলার আসামি চিহ্নিত দুর্বৃত্ত; যাদের আছে থানা-পুলিশের সঙ্গে সখ্য, ফিল্মি কায়দায় ধর্ষণ ও হত্যা করল অপো রাণী রায়, সাদেকা বেগম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আঞ্জুয়ারা ও লতা রানীকে। এমনকি সেই পাষণ্ডগুলোর হাত থেকে রক্ষা পায়নি অবুঝ শিশু বিপাশা। বিপাশাকে হত্যা উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে এই পাষণ্ডরা। যার ফলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো বিপাশা।
সবাই দেখল, ছবি তুলল, ভিডিও করল; আবার উল্লসিত হৃদয়ে ছবি আপলোড করে দিল ফেসবুকে। কী আনন্দ ওদের। একটা অকল্পনীয় ঘটনার ছবি তুলতে পারল। কত লাইক পাবে। কত তাদের সুনাম হবে।
হায় রে বাঙালি! মানুষকে না বাঁচিয়ে ছবি তুলে বাহবা নিতে ব্যস্ত। অথচ এ বাঙালিরাই একাত্তরে বীরবিক্রমে ধর্ষক পাক আর্মি আর রাজাকারদের পিটিয়ে মেরেছে লাঠি হাতে, দেশের মা-বোনদের হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষার্থে, তাদের সম্ভ্রম বাঁচাতে। নিজেরাও মরেছে, ধরা পড়েছে, অত্যাচারিত হয়েছে, জীবন দিয়েছে; কিন্তু মা-বোনদের নির্যাতিত হতে দেয়নি, কোনো বোনের ভাইকে কিংবা বাবা-মায়ের কন্যাকে মরতে দেয়নি, দেয়নি সম্ভ্রম হারাতে।
অথচ পঞ্চাশ বছর পার হতে না হতেই এ কী হাল হল আমাদের দেশের তরুণ-যুবকদের? কেন এরা ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে দিনকে দিন। তাহলে কি আমরা ধরে নেব তরুণ প্রজন্মের অবক্ষয় ঘটেছে! কেন বা তারা হারিয়ে যাচ্ছে অজানা কোনো জগতে, গুটিয়ে রাখছে নিজের মধ্যেই নিজেকে? আজ খুব ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করতে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের আজ আপনারা কোথায়? এজন্য কি আপনারা দেশ স্বাধীন করেছিলেন?
অপো রাণী রায়,সাদেকা বেগম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আঞ্জুয়ারা ও লতা রানী ও অবুঝ শিশু বিপাশা’র আর্তনাদ কি কারও মনে একটুও কম্পন তুলতে পারল না? আমরা আজ সবাই তামাশা দেখছি।
ধর্ষণকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় এনে কঠোর থেকে কঠোরোতর শাস্তি দেওয়া হইতো তাহলে এই মানুষ রুপি পশুগুলো ধর্ষণের আগে বারবার ভাবতো। ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে আজ যদি খানসামা উপজেলায় এই ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে জনগণ রাজপথে নামতো তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে আমাদের এই আর্তনাদ আর শুনতে হতো না এমনকি প্রশাসনেরও টনক নড়ে যেতো।
খানসামা উপজেলায় একেরপর এক হত্যা কান্ড ঘটলো, অথচ কেউ টুঁ শব্দটিও করল না। ‘বীর পুরুষরা’ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল, দর্শক সাজল, ফটোগ্রাফার-ভিডিওগ্রাফার হল। মনটি যারা করেছে, তারাও হত্যাকারীদের মতোই সমান অপরাধী। এ ধরনের লোকরাই সমাজকে পতনের দিকে ঠেলে দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ের খানসামা উপজেলায় ‘ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক।…সমাজটা কোথায় যাচ্ছে? কেউ প্রতিবাদও করছি না। এটি জনগণের ব্যর্থতা। যারা সমাজকে রক্ষায় অবহেলা করছে তাদের কে রক্ষা করবে?
খানসামার হত্যাকাণ্ডটি আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলেও এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে গেলে জাতির সামনে ঘনিয়ে আসবে জমাট অন্ধকার। এমন ঘটনা ঘটাতে প্রভাবশালীদের ছায়াতলে থেকে অন্য সন্ত্রাসীরাও উদ্বুদ্ধ হবে।
অনুরূপ ঘটনা এখন ঘটছে অহরহ। পত্রিকা উল্টালেই দেখা যায় প্রতিদিন অনেক ধর্ষণের ঘটনা। সামান্য কারণে, ব্যক্তিগত বিরোধের সূত্র ধরে কিংবা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে মানুষ মানুষকে মারছে।
প্রতিদিন নির্মমতার বহু খবর পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি ধর্ষণ তো এখন নিত্যদিনের ঘটনা? সব ঘটনা তো মিডিয়ায় আসেও না।
ঘরে ঘরে পুলিশ দেয়া যাবে না, এ কথা যেমন ঠিক; তেমনি পুলিশ আর সমাজপতি-সালিশকারীরা চোখ বন্ধ করে থাকলে কিংবা দেখেও না দেখার ভান করলে যা হওয়ার তা-ই হবে। সমাজ উচ্ছন্নে যাবে আর তার ভয়ানক পরিণতির শিকার হবে একদিন পুলিশ-সমাজপতিদের পরিবারও। মুক্তি মিলবে না কারও।
আমরা চাই না, অজানা আতঙ্কে নিত্যদিন শঙ্কিত থাকুক নারী সমাজ ও নিরীহ মানুষ, ঘুম হারাম করে দিয়ে রাত জেগে থাকুক কিশোরী-যুবতী কন্যার ইজ্জত বাঁচাতে, কিশোর-তরুণ ছেলে বা মেয়েকে স্কুল-কলেজে পাঠাতে গিয়ে মা-বাবার বুক ধড়ফড় করুক সারাদিন, কোনো নারী সম্ভ্রম হারিয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরুক নিজে বেঁচে যাওয়ার জন্য, কোনো নির্যাতিতা গৃহবধূ স্বামীর বাড়ি ছাড়া হয়ে পথে বসুক আর ভিক্ষুকের জীবনযাপন করুক সারাজীবন, সন্তান অপহরণের ভয়ে রাতদিন যন্ত্রণাবিদ্ধ জীবন কাটাক কোনো মা-বাবা কিংবা মাদকসেবী অমানুষদের কবলে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাক কোনো পরিবার।
সামাজিক অপরাধ আর পারিবারিক অপরাধ বীভৎস রূপ নিচ্ছে। মানুষ মানুষকে কীভাবে সামান্য কারণে খুন করছে বা অত্যাচার করছে, তা দেখলে-শুনলে পত্রিকা পড়তে ইচ্ছা করে না; কারও কাছে শুনতেও ইচ্ছা হয় না। গবেষণার মাধ্যমে সময় থাকতেই সঠিক কারণ নির্ণয় করা জরুরি।
সর্বোপরি সমাজ থেকে খুন ধর্ষণ নির্যাতন রোদে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন, গণপ্রতিরোধ।