যশোরের কেশবপুর উপজেলার মেহেরপুর গ্রামের রহিমা খাতুনের প্রেমের টানে আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস্ট মার্ক হোগল বাংলাদেশে এসে দেখতে দেখতে পাঁচ বছর পার করে দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে আসার পর প্রথম দিকে গ্রামের মানুষের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারলেও এখন মানিয়ে নিতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত জীবনযাপনে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এই দম্পতি।
ক্রিস্ট মার্ক ও রহিমার অভিযোগ, দেশে আসার পর প্রথম দিকে এলাকার মানুষ তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত। মাস কয়েক পর ক্রিস্ট মার্কের কাছে বিভিন্ন সমস্যা ও অজুহাতে আর্থিক সহযোগিতার জন্য প্রতিবেশীরা বাড়িতে আসত এবং দ্রুত দেনা পরিশোধের আশ্বাস দিয়ে ক্রিস্ট মার্কের কাছ থেকে টাকা ধার নিত। ক্রিস্ট মার্কও সমস্যার কথা শুনে কাউকে খালি হাতে ফেরত যেতে দিতেন না। পরবর্তীতে ধার দেওয়া টাকা চাইতে গেলে নানা রকম হুমকি-ধমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে ক্রিস্ট মার্ক ও রহিমাকে। এ পর্যন্ত মেহেরপুর গ্রামে প্রতিবেশীদের কাছে মোট ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা পাবেন বলে দাবি করেছেন ক্রিস্ট মার্ক।
এদিকে ক্রিস্ট মার্ক যশোরের কেশবপুরের মেহেরপুর গ্রামে আসার পর চারতলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে বাড়ির চারটি ছাদের ঢালাই শেষ হতে না হতেই ক্রিস্ট মার্কের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটে। মেহেরপুর গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দূরে হওয়ায় তিনি তার নির্মাণাধীন বাড়িটিতে একটি প্রাইভেট হাসপাতাল তৈরি করতে চান। হাসপাতালটির নাম দিতে চান রহিমা সোলজার্স। এই হাসপাতালে আমেরিকান এবং বাংলাদেশি চিকিৎসকরা সেবা দেবেন।
রহিমা বলেন, আমরা দেশে আসার পর কিছু দিন সামাজিকভাবে শান্তিতে বসবাস করছিলাম। আমার স্বামী ক্রিস্ট মার্কের সরলতার সুযোগ নিয়ে গ্রামের কিছু লোকজন তার থেকে কয়েক লাখ টাকা ধার নেয়। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পরে এসব টাকা দিতে অস্বীকার করে। তাদের কাছে টাকা চাইতে গেলে নানা রকম হুমকি-ধমকির সম্মুখীন হতে হয়।
তিনি আরও বলেন, সাংসারিকভাবে আমি আমার স্বামী ক্রিস্ট মার্ক এবং আমার সন্তানদের নিয়ে সুখে থাকলেও সমাজ আমাদের একঘরে করে দিচ্ছে। আমাদের ব্যবহার করে এখন আমদেরই দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। ক্রিস্ট মার্ক খ্রিস্টান থেকে মুসলিম হওয়ায় সমাজের অনেকে আমাদের আজেবাজে কথা বলে। ক্রিস্ট মার্কের সঙ্গে বর্তমানে এলাকার অনেকে খারাপ ব্যবহার করে।
রহিমা বলেন, ক্রিস্ট মার্ক এখানে একটি বাড়ি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তার এ সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি গ্রামের মানুষের কথা চিন্তা করে তার বাড়িটিতে একটি প্রাইভেট হাসপাতাল তৈরি করবেন। আগামী এক বছরের মধ্যে এ হাসপাতাল তৈরির কাজ শেষ করবেন।
ক্রিস্ট মার্ক হোগল বলেন, আমি অনেক সুখে আছি এখানে। আরও বেশি ভালো আছি রহিমাকে পাশে পেয়ে। আমি রহিমাকে এক মুহূর্তও চোখের আড়াল করতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, এলাকার কিছু মানুষকে আমি টাকা দিয়েছিলাম। তারা আমাকে টাকা ফেরত দেয়নি এখনো। এই টাকাগুলো ফেরত না পেলে আমি খুব সমস্যায় পড়ব।
মেহেরপুর গ্রামের বাসিন্দা কবীর হোসেন বলেন, রহিমা এবং ক্রিস্ট মার্ক খুব সুখে শান্তিতে আছে। তবে সামাজিকভাবে তাদের এ সুখী জীবনযাপনে অনেকে জটিলতা সৃষ্টি করছে। ক্রিস্ট মার্কের কাছে কেউ সাহায্য চাইতে এসে খালি হাতে ফেরেননি। তবে ক্রিস্ট মার্ক এলাকার মানুষদের অর্থ ধার দিয়ে উপকার করলেও এলাকার মানুষ তার প্রতিদানে তাকে হেয় করছে।
তুহিন হোসেন বলেন, ক্রিস্ট মার্ক একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। এখানে তিনি একটি হাসপাতাল নির্মাণ করবেন। তবে তিনি অনেক মানুষকে লাখ লাখ টাকা ধার দিয়েছেন। যেগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি। টাকাগুলো উদ্ধার হলে তার এ হাসপাতাল নির্মাণ আরও সহজ হবে। এ বিষয়ে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
এদিকে প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে রহিমার এমন অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ক্যামেরার সামনে কেউই কথা বলতে চাননি। তবে অনেকে নাম না প্রকাশ করা শর্তে রহিমার এ সকল অভিযোগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
শুধু প্রতিবেশী নয়, বার বার বিভিন্ন সমস্যার কথা সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান মুক্তকে জানালেও তিনিও এ সব অভিযোগের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ করেছেন রহিমা। এ বিষয়ে কথা বলতে ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান মুক্তকে না পেয়ে একাধিকবার তার মুঠোফোনে ফোন দিলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এমএম আরাফাত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রহিমা এবং ক্রিস্ট মার্ক তারা কেউই আমার কাছে এখনো আসেননি। তারা যদি এসে লিখিত অভিযোগ দেন সেক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের ডকুমেন্টস থাকলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
প্রসঙ্গত, যশোরের কেশবপুর উপজেলার মেহেরপুর গ্রামের মৃত আবুল খার মেয়ে রহিমা খাতুন। শৈশবে বাবা-মায়ের হাত ধরে অভাবের তাড়নায় পাড়ি জমান ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। বাবা শ্রম বিক্রি করতেন। ১৩ বছর বয়সে বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। একে একে তার কোলজুড়ে আসে তিনটি সন্তান।
সংসারে অভাব-অনটনের কারণে তার প্রাক্তন স্বামী গ্রামের জমি বিক্রি করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। বাধ্য হয়ে জীবিকার সন্ধানে মুম্বাই শহরে যান রহিমা। মুম্বাই শহরে থাকাকালে হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় ক্রিস্ট মার্ক হোগলের সঙ্গে রহিমার পরিচয় হয়। প্রথম দেখাতেই রহিমাকে ভালো লেগে যায় তার।
হিন্দিতে দু-এক লাইন কথা বলার পর তারা আবার দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই ভালো লাগাটা আস্তে আস্তে ভালোবাসায় রূপ নেয়। ছয় মাস প্রেমের পর তারা বিয়ে করেন। পরে তারা কেশবপুরের মেহেরপুর গ্রামে রহিমার বাবার ভিটায় ফিরে আসেন। সেখানেই দেখতে দেখতে পার করেছেন পাঁচটি বছর।