ঢেউয়ের তোড়ে অব্যাহত ভাঙনের ফলে প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য। চলতি বর্ষা মৌসুমের অস্বাভাবিক জোয়ারে এ ভাঙন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। ঢেউয়ের ঝাপটায় ক্ষয়ে যাচ্ছে বালু। এতে ধীরে ধীরে সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে মেরিনড্রাইভসহ শত শত গাছপালা। ভাঙনের কবলে পড়েছে সমুদ্র তীরের বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এদিকে, বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের পানিতে সৈকত তলিয়ে থাকায় পর্যটকরাও বাধ্য হচ্ছেন রাস্তায় কিংবা বনাঞ্চলে দাঁড়িয়ে কক্সবাজার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। সব মিলিয়ে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে সমুদ্রপ্রিয় মানুষের অন্যতম প্রিয় কক্সবাজার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝাপটা ও অব্যাহত বালুক্ষয়ে দীর্ঘ প্রায় ১০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সৈকতের বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য গাছের মূল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চলতি বর্ষা মৌসুমে প্রচণ্ড ঢেউয়ের ঝাপটায় গাছের মূল থেক বালু সরে যাওয়ায় গাছ উপরে পড়েছে। মেরিনড্রাইভের পাশেও অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়ে আছে। পর্যটকরা বলছেন, জোয়ারের সময় সমুদ্রস্নানে মারাত্মক অসুবিধা হচ্ছে তাদের। এছাড়া ঝুঁকিতে রয়েছে সৈকতের সবুজ বেষ্টনী, মেরিনড্রাইভ, দোকান-পাটসহ মসজিদ-স্কুল।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ওড়িষ্যা উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত স্থল নিম্নচাপটি পশ্চিম দিকে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে সুস্পষ্ট আকারে বর্তমানে ভারতের ছত্তীসসগঢ় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরো উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য বিরাজ করছে। সমুদ্র বন্দরসমূহ, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এতে পর্যটনে বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। আর দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
“কক্সবাজারকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সুস্পষ্ট লঘুচাপ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের নিম্না ল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ০২-০৪ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে চলাচলের জন্য বলা হয়েছে।”
এদিকে বুধবার বিকেলে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, সাগর উত্তাল, জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৪ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। কক্সবাজারে ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।
সৈকতের লাবণী পয়েন্ট; উচ্চ জোয়ারের আঘাতে ঝুঁকির মুখে ট্যুরিস্ট পুলিশের স্থাপনা। একদিকে ভাঙনের কারণে যেকোন মুহুর্তে ভেঙে পড়তে পারে স্থাপনাটি। যার জন্য জিও ব্যাগ দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সৈকতের অন্যতম পয়েন্ট লাবণী জোয়ারের পানিতে ভেঙ্গে তছনছ। পানিতে কমলে ভেসে উঠছে ভাঙনের চিত্র।
সৈকতের কিটকট (ছাতা) ব্যবসায়ী শুক্কুর বলেন, উচ্চ জোয়ারের কারণে প্রতিদিন ৬ বার করে ছাতা সরিয়ে নিয়ে শুকনো স্থানে রাখতে হচ্ছে। এতে পর্যটকদেরও ছাতা থেকে উঠে পুনরায় আরেক স্থানে বসতে হচ্ছে। আর জোয়ারের পানিতে একের পর এক বালিয়াড়ি ভেঙ্গে যাচ্ছে।
লাবণী পয়েন্টে দায়িত্বরত লাইফ গার্ড কর্মী মোহাম্মদ জহির বলেন, এত উচ্চ জোয়ার আর কোন বছর দেখিনি। এবছর সর্বোচ্চ জোয়ারের পানি আঘাত করছে উপকূলে। এতে সৈকতের মাদ্রাসা পয়েন্ট থেকে শুরু করে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত বালিয়াড়ি ভেঙ্গে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ঝুঁকির মুখে পড়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশের স্থাপনাও। শুধু সৈকতের লাবনী পয়েন্ট নয়; মাদ্রাসা পয়েণ্ট থেকে শুরু করে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত উচ্চ জোয়ারে ভাঙছে বালিয়াড়ি। যার কারণে সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়ছে সৈকত। আর সৈকতে নামতে গিয়ে অনেক সময় আহত হচ্ছেন পর্যটকরা।
রুয়েটের শিক্ষার্থী শিহাব বলেন, দলবেধে লাবণী সৈকতে নেমেছিলাম। কিন্তু জোয়ারের কারণে জিও ব্যাগ তলিয়ে গেছে। একই সঙ্গে ইটের রাস্তা ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। যার ফলে সাগরের নোনাজলে নামতে গিয়ে হোচট খেয়ে আমাদের দুই বন্ধু পড়ে গেছে। এরকম ভাঙনের দৃশ্য আগে কখনও সৈকতে এসে দেখিনি। গেলো কয়েকবছর ধরে প্রতিদিন সৈকতে হাটেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন অফিসের অতিরিক্ত কমিশনার মো. সামছু-দ্দৌজা।
তিনি বলেন, কয়েকবছর ধরে সাগরের বালিয়াড়ির ভাঙন তীব্র হচ্ছে। সারা বিশে^র ন্যায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কক্সবাজারও পড়ছে। তাই সৈকতের তীব্র ভাঙন রোধে পরিবেশবান্ধব কার্যকরি ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি।
আর পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা হবে। কক্সবাজার পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, গত কয়েকবছর ধরে সৈকতে ডায়বেটিক পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত বর্ষামৗসুমে ভাঙন তীব্র হচ্ছে। এতে প্রাথমিকভাবে সৈকতের মাদ্রাসা পয়েন্ট থেকে লাবণী পয়েন্টের কিছু অংশ জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে স্থায়ী কিভাবে ভাঙন রোধ করা যায় দ্রুত তার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সৈকতের লাবণী থেকে শুরু মাদ্রাসা পয়েন্ট জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধ করার চেষ্টা করা হলেও তা কোন কাজে আসছে না। তাই স্থায়ী সমাধানের দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রাসহ পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।