নির্বাচন শেষ। কর্মী, সমর্থক ও ভোট বর্জন করা সাধারণ জনগণের এখন একটাই প্রশ্ন, কী করবে বিএনপি। জানা গেছে,
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট বর্জনের পর এখন ‘পরিস্থিতি’ বুঝে সামনের দিকে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। দলটির নেতারা মনে করছেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনগণ একতরফা ভোট বর্জন করেছে। তাদের দাবি, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ার কথা বলা হলেও মূলত ৫-১০ ভাগ ভোট পড়েছে। নির্বাচনে এই ভোটার উপস্থিতি কম হওয়াকে আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য হিসেবে দেখছেন তারা।
দলটির দাবি, ভোটারবিহীন এই নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাদের প্রত্যাশা, এমন ভোটের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব সোচ্চার হবে এবং তাদের পক্ষ থেকে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ প্রয়োগের পদক্ষেপ আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে নতুন সরকারের টিকে থাকা কঠিন হবে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কঠোর কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি।
জানা গেছে, নির্বাচন হলেও শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন অব্যাহত রাখবে বিএনপি। নির্বাচনের ফলাফল বাতিল এবং নতুন নির্বাচনের দাবিতে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাবে দলটি। প্রাথমিকভাবে ন্যূনতম দেড় মাস কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সভা-সমাবেশসহ জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। তবে কর্মসূচির ফাঁকে মাঝেমধ্যে হরতালও দেয়া হতে পারে। নতুন সরকারের শপথ এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম দিন হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে। গত রোববার রাতে ভার্চুয়াল মাধ্যমে দলের স্থায়ী কমিটি এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের সাথে পৃথক বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
নির্বাচনের পরে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি হিসেবে দুই দিনের গণসংযোগ করবে বিএনপি। গণসংযোগ কর্মসূচি হিসেবে ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করায় ভোটারদের ধন্যবাদ জানিয়ে আজ মঙ্গলবার এবং আগামীকাল বুধবার সারা দেশে লিফলেট বিতরণ করা হবে। এই কর্মসূচির মেয়াদ আরো বাড়তে পারে।
জানা গেছে, বৈঠকে সরকারকে চাপে ফেলতে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দেন কেউ কেউ। তবে নীতিনির্ধারকদের আলোচনায় উঠে এসেছে, হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিলে সেটিকে ঘিরে অন্য কোনো পক্ষ নাশকতা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর এর দায় চাপিয়ে দেয়। বিএনপি সরকার বা অন্য কোনো পক্ষকে এমন সুযোগ দিতে চায় না। তা ছাড়া বিএনপির বহু নেতাকর্মী এখন কারাগারে। আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকে ঘরছাড়া, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের আগে কারামুক্ত করা দরকার। এখন কঠোর কর্মসূচিতে গেলে তাদের জামিন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে। নেতাদের ধারণা, নির্বাচন হয়ে গেছে। এখন সরকার তাদের মুক্তিতে বাধা সৃষ্টি নাও করতে পারে। সরকার বাধা না দিলে কম সময়ের মধ্যে তারা জামিনে কারামুক্ত হতে পারেন। এতে দল নতুন করে সুসংগঠিত, চাঙ্গা হবে। আন্দোলন এগিয়ে নিতে যা সহায়ক হবে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
ভোট বর্জন করায় জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি লিফলেট তৈরি করেছে বিএনপি, যা আজ ও কাল বিতরণ করা হবে।
বিএনপির লিফলেটে বলা হয়েছে, ‘৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের নামে বানরের পিঠা ভাগের মতো আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে জাতীয় সংসদের আসন ভাগাভাগি করে নিয়েছে। আপনারা ফ্যাসিবাদী সরকারের ডামি নির্বাচন ঘৃণাভরে বর্জন করেছেন। বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের ৬৩টি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আপনাকে আবারো রক্তিম শুভেচ্ছা। বীরোচিত অভিনন্দন। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বার কোটি মানুষের লুণ্ঠিত ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। আপনি যে দল কিংবা যে মতেরই হোন, আমাদের হাতকে শক্তিশালী করুন। আমাদের সাথে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিন। আপনার সাধ্য ও সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে বিএনপিসহ ৬৩টি রাজনৈতিক দলের চলমান আন্দোলনের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। আপনার তথা প্রতিটি নাগরিকের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই আমাদের চলমান আন্দোলন। এ আন্দোলন সফল করতে হলে শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিকল্প নেই। শেখ হাসিনা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। গণতন্ত্রকামী জনগণের আন্দোলন কখনো বৃথা যায় না, যেতে পারে না, যেতে দেয়া হবে না।’
এ দিকে বিএনপি আন্দোলন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ভোটে সহিংসতা, জাল ভোটসহ নানা অনিয়মের ঘটনা নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করছে। ইতোমধ্যে ২৯৯ আসনে অনিয়মের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে দলটি। শিগগিরই ঢাকাস্থ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হবে। এ ছাড়া তাদের মাধ্যমে এগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছানো হবে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ায় ভারত, চীন, রাশিয়াসহ অনেক দেশ ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো কোনো কিছু বলেনি। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপি নেতারা বলছেন, দেখা গেছে- নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোটের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশে নির্বাচন ঘিরে শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল। তাদের সংলাপের আহ্বানও আমলে নেয়নি সরকার।
দলটির কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি কেমন ভোট হয়েছে, তা ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে স্পষ্ট হয়ে গেছে। জনগণ নির্বাচনী তামাশা প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ার দাবি করা হলেও বাস্তবে ৫-১০ শতাংশ ভোট পড়েছে। তা ছাড়া পশ্চিমারা এই নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষকও পাঠায়নি। এর মধ্য দিয়ে কার্যত তারাও এই নির্বাচন বয়কট করেছে। ফলে ভোটারবিহীন, ডামি, প্রহসনের নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ প্রয়োগমূলক পদক্ষেপ আসতে পারে। তেমনটা হলে পরিস্থিতিও পাল্টে যাবে। সে ক্ষেত্রে আন্দোলনও নতুন গতি লাভ করবে। এর ফলে নতুন সরকারের টিকে থাকা কঠিন হবে। এ দিকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর কঠোর আন্দোলন সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা হতাশাও বিরাজ করছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং পরিবর্তন হবে এমন প্রত্যাশার পরেও আরেকটি নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় অনিশ্চয়তার যাত্রা আবার শুরু হয় কিনা, তা নিয়ে শঙ্কিত নেতাকর্মীরা। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের হতাশ না হয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।- মঈন উদ্দিন খান