১৭, মে, ২০২৪, শুক্রবার
     

ক্ষমতাশালীদের কটূক্তির অভিযোগেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৪০ শতাংশ মামলা

তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিক্যাল নাইনটিন বলছে, ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে।

সরকারি দলের এসব নেতাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা ছাড়ারও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো সংগঠনের নেতারাও রয়েছেন, যাদের নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছে।

তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরু বলছেন, মামলার উপাদান ছিল বলেই এসব মামলা হয়েছে।

‘কাউকে কটূক্তি করলে বা কুৎসা রটনা করলে তো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তার পক্ষে কেউ আইনের সুরক্ষা চাইতেই পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

আর্টিকেল নাইনটিন বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া ২২৫টি মামলায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ৪১৭ জন ব্যক্তি অভিযুক্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ৬৮ জন সাংবাদিকও আছে। এসময় ১৫ জন সাংবাদিক এই আইনের আওতায় গ্রেফতার হয়েছেন।

আর মামলাগুলো দায়েরের পরপরই বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে ১৬৬ জনকে আটক করা হয়েছে।

আর্টিকেল নাইনটিন, দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক, ফারুখ ফয়সল বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি মামলার বিষয়গুলো আমরা বিশেষভাবে মনিটর করি। এ বছর যা দেখছি যে ৯০টির মতো মামলা হয়েছে শুধু ক্ষমতাশালীদের কটূক্তির অভিযোগে। এটি প্রমাণ করে যে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে অপব্যবহার করছে।’

ফারুখ ফয়সল বলছেন, ‘দল নয় বরং আইন হতে হবে মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য। কিন্তু ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সেটি করতে পারছে না। সে কারণে আইনের সংশোধনীর কিছু প্রস্তাব তারা সরকারকে দিয়েছেন।’

আর্টিক্যাল নাইনটিনের দেয়া তথ্য
– ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে ২২৫ মামলায় ৪১৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৬ জনকে তাৎক্ষণিকভাবে আটক করা হয়েছে।

– দায়েরকৃত মামলার মধ্যে ১৮৬টিই হয়েছে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত প্রকাশের কারণে।

– আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ১৬৩টি মামলা করেছে মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য, অশালীন মন্তব্য, আইনের অবমাননা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হেয় করার অভিযোগে।

– মোট মামলার মধ্যে ৯০টিই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ প্রভাবশালী নেতাদের কটূক্তির অভিযোগে।

– ৩২ মামলায় ৬৮ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যদিও এর বেশিরভাগই ছিল তাদের সাংবাদিকতার অংশ হিসেবে করা রিপোর্ট বা সেগুলো অনলাইনে শেয়ার করার কারণে। এদের মধ্যে ১৫ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কী, কেন এত বিতর্ক, কী আছে এ আইনে
২০১৮ সালে বাংলাদেশের পার্লামেন্টে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রস্তাবের পর থেকেই উদ্বেগ বিতর্ক আর সমালোচনা শুরু হয়।

আইনটি প্রস্তাবের পর থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের কর্মীরা। তাদের আশঙ্কা, আইনটির অনেক ধারায় হয়রানি ও অপব্যবহার হতে পারে।

আইনটি পাসের পরপরই সম্পাদক পরিষদ ঢাকায় এর বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছিল।

সেখানে বলা হয়েছিল, আইনটির ৮, ২১, ২৫সহ বেশ কিছু ধারা সংশোধন করতে হবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার স্বার্থে।

মূলত আইনটির যেসব বিধান নিয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে সেগুলো হলো :
• ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেফতার করতে পারবে।

• আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে এই আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

• আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

• ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তিন থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার এরকম অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

পেন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ও বাংলাদেশ ইন্টারনেট ফ্রিডম ইনিশিয়েটিভ ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য ড. সৈয়দা আইরিন জামান বলছেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো একটি বিষয় মাথার উপর আছে বলেই মানুষ সঠিক সংবাদ জানতে পারছেন না এবং এ কারণে ফেক নিউজ ও বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে মানুষ বেশি মাতামাতি করে।’

তিনি বলেন, অবাধ তথ্য প্রবাহ থাকলে এতো গুজব ছড়াতো না এবং গুজবকে কেন্দ্র করে সহিংসতাও হতো না।

সূত্র : বিবিসি

               

সর্বশেষ নিউজ