১৯, মে, ২০২৪, রোববার
     

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর এখন পর্যন্ত হয়নি ‘বন্দুকযুদ্ধ’

গত ১০ ডিসেম্বর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর বর্তমান ও সাবেক ৭ শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার সম্পর্কিত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর থেকে এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অপরাধীদের মধ্যে কোনো ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়নি।

মানবাধিকার সংস্থার তথ্য ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১০ ডিসেম্বরের আগে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মানুষ হত্যা একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসার কয়েক ঘণ্টা আগেও বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় র‌্যাব ও ডাকাত দলের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক সন্দেহভাজন ‘ডাকাত’ নিহত হন। এর মাত্র ৪ দিন আগে ভোলায় এলিট ফোর্সের সঙ্গে এমনই আরেকটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আরও ২ সন্দেহভাজন ‘ডাকাত’ নিহত হন।

কুমিল্লার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হত্যা মামলার ৩ আসামি গত বছরের ৩০ নভেম্বর ও ২ ডিসেম্বর ভোরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড এখন না হওয়া এটাই প্রমাণ করে যে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে হত্যা করা কিংবা তা বন্ধ করা সম্পূর্ণভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভর করে।

সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাধারণত দাবি করে, অপরাধীরা প্রথমে গুলি চালানোর পর এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু বাস্তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ধরনের ঘটনা ‘সাজায়’ বলে মন্তব্য করেন মানবাধিকার কর্মীরা।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার পরেও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বিরতি দেখা যায়। এই ঘটনার পরে প্রায় ৫ মাসে কেবলমাত্র ২ আগস্ট সিলেটে একটি ছাড়া সারা দেশে আর কোনো ‘বন্দুকযুদ্ধের’ খবর পাওয়া যায়নি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম ৭ মাসে ১৮৪ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন।

মেজর (অব.) সিনহাকে হত্যার পর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সে বছরের ৬ আগস্ট এক বিবৃতিতে জানায়, তৎকালীন সেনাপ্রধান ও পুলিশ মহাপরিদর্শক তাদের নিজ নিজ বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছিলেন যাতে ‘এমন ঘটনা’ ভবিষ্যতে আর না ঘটে।

২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং অপরাধীদের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৫১ জন নিহত হয়েছেন বলে জানায় আসক।

গত রোববার দ্য ডেইলি স্টারকে মানবাধিকার কর্মী নুর খান বলেন, এগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি অনুযায়ী ঘটেনি।

তিনি বলেন, ‘যদি “বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা সত্যি হতো তাহলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বা মেজর (অব.) সিনহাকে হত্যার পরেও তা অব্যাহত থাকত। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরে আমরা দেখেছি, একজনকে র‌্যাব হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এটা খুব স্পষ্ট, যদি সরকার চায় তাহলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ বা চালিয়ে যেতে পারে।’

এই ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিশেষ পরিস্থিতিতে বা বিভিন্ন সময়ে বৃদ্ধি, হ্রাস বা বন্ধ হয় জানিয়ে এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, ‘নির্বাচনের সময় বা আগে গ্রেপ্তারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় গুমের সংখ্যা বেড়ে যায়।’

‘যখন কোনো বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বা মানুষ যখন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে তখন এই ধরনের ঘটনা বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে এটা মনে হতে বাধ্য যে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে শাসকদের কৌশল হতে পারে। যাতে করে মানুষ কোনো অপরাধ বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারে,’ যোগ করেন নুর খান।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ২০০২ সালের প্রথম দিকে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। ২০০৪ সাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং অপরাধীদের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শুরু হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের মতে, ২০০১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অন্তত ৩ হাজার ১৩৫ জন নিহত হয়েছেন।

দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর আগের ২ বছরের তুলনায় ২০১৮ সালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের সংখ্যা বেড়েছে।

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বলেছিল, ক্ষমতায় গেলে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ বন্ধ করা হবে।

দলটি ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনকে জানায়, বাংলাদেশ বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু কেবল মার্চ মাস ছাড়া ওই বছর জুড়েই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়েছে।

‘বন্দুকযুদ্ধে’ বিরতির বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের পরিচালক (আইনি ও মিডিয়া উইং) কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গতকাল বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা কোনো বিশেষ পরিস্থিতি বা সময়ের ওপর নির্ভর করে না। এটা নির্ভর করে অভিযানের পরিস্থিতির উপর। যখন অপরাধীরা প্রথমে গুলি চালায় তখন ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়।

তিনি দাবি করেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন আমাদেরকে আত্মরক্ষায় গুলি চালানোর অনুমতি দিয়েছে। এটা মানবাধিকারের বিষয় নয়। আমরা হয়তো গত ১ মাসে আক্রমণের মুখে পড়িনি। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, বন্দুকযুদ্ধ কোনো রুটিন সমস্যা নয় যে প্রতিদিন ৫-৭টি হবেই। আমরা যখন আক্রমণের মুখে পরি কেবল তখনই গুলি চালাই।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ১০ ডিসেম্বর র‌্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান ৭ জন শীর্ষ কর্মকর্তার উপর মানবাধিকার সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট একটি পৃথক বিবৃতিতে বলেছে, ২০১৮ সালের মে মাসে টেকনাফ পৌর কাউন্সিলরের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনে জড়িত থাকার জন্য তারা র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজিরসহ র‌্যাবের ২ কর্মকর্তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

২০১৮ সালের ২৬ মে টেকনাফ ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামুল হককে হত্যার ঘটনায় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ চলাকালীন একটি ফোন কল ফাঁস হওয়ার পর দেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

               

সর্বশেষ নিউজ