২৭, জুলাই, ২০২৪, শনিবার
     

যে ‘কূটকৌশলে’ তেল নিয়ে ‘তেলেসমাতি’ ব্যবসায়ীদের

বোতলজাত তেলকে লুজ বা খোলা তেলে পরিণত করে নারায়ণগঞ্জে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন তেল কোম্পানির ডিলার ও বড় মোকাম ব্যবসায়ীদের এ কূটকৌশলের কারণে বোতলজাত সয়াবিনের হাহাকার পড়েছে। ফলে জেনেশুনেই অতিরিক্ত দামে বোতলজাত তেল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ভোক্তারা।

জেলার বিভিন্ন বাজারের মধ্যম ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, তেল কোম্পানির ডিলার ও বড় মোকামের ব্যবসায়ীদের বোতলজাত তেলের ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব নিলেই বেরিয়ে আসবে এ কৌশলের রহস্য।

তারা বলছেন, সরকার বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের পক্ষ থেকে ঈদের আগে থেকেই বলা হচ্ছিল তেলের কোনো সংকট নেই। অথচ ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই কেন ডিলাররা তেল সরবরাহ বন্ধ রেখেছিল তা সর্বাগ্রে খতিয়ে দেখা দরকার।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিলার ও বড় বড় মোকাম ব্যবসায়ীরা জানতেন তেলের দাম বাড়বে। বোতলজাত তেল কনজিউমার প্রোডাক্ট হওয়ায় গায়ে লেখা দামের হেরফের করা কঠিন। যেহেতু সরকার খোলা তেলের যে মূল্য নির্ধারণ করেছিল তা বোতলজাত তেলের চেয়ে লিটারপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেশি ছিল। এ সুযোগে ঈদের আগেই ৫ ও ৮ লিটারের বোতলজাত তেল মজুদ করে সেগুলোকে ড্রামজাত করে লুজ বা খোলা তেল হিসেবে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই সিন্ডিকেট।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের অন্যতম বৃহত্তম নিত্য খাদ্যপণ্য ও ভোজ্যতেলের পাইকারি মোকাম নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে ও নগরীর অন্যতম বড় দিগুবাবু বাজার, কালীর বাজারে সয়াবিন তেল নিয়ে চলেছে ‘তেলেসমাতি’। বোতলজাত তেলকে খোলা তেলে পরিণত করায় এখন ঈদের পর বোতলজাত তেলের চরম সংকট চলছে বাজারগুলোতে।

শহরের ২টি বড় বাজারে সরেজমিন জানা গেছে, তেলের দাম নতুন করে নির্ধারণ করা হলেও বাজার ঘুরে পাওয়া যাচ্ছে না তেল। নতুন মূল্যের চাইতেও অধিক মূল্যে কয়েকটি দোকানে পাওয়া যাচ্ছে তেল। বাজারের প্রতিটি দোকানেই ৮ থেকে ১০টির বেশি সয়াবিন তেলের বোতল নেই। আবার কোনো দোকানে একটিও নেই। যার দোকানে বেশি আছে তিনি দাম চাইছেন ২২০ টাকা কেজি।

ক্রেতারা দাম কম রাখার অনুরোধ করলে বিক্রেতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলেন, ‘বাজারে তেলই নেই, কম রাখবো কিভাবে।’ তবে ঈদের আগে লুজ বা খোলা তেল বিক্রি হলেও হঠাৎ করেই এসব বাজারে এখন লুজ তেল উধাও।

সরেজমিন পুরো দ্বিগুবাবুর বাজারে লুজ তেল বিক্রি করছেন মাত্র ১ জন বিক্রেতা আর কালীর বাজারে লুজ তেলের দেখা মেলেনি। কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেল, ঈদের পর নতুন রেট দিয়ে যে বোতলজাত তেল এসেছে তা লিটার প্রতি সর্বনিম্ন ১৯৬ টাকা পড়ছে। তাই বোতলজাত রেখে ২০০ টাকা লিটার লুজ তেল কেউ কিনবে না বলেই এ অবস্থা।

শুধু সয়াবিনই নয়। সংকট রয়েছে পাম অয়েলেও। নারায়ণগঞ্জের সর্ববৃহৎ এই খুচরা বাজার ঘুরে মাত্র দুই-তিনটি দোকানে পাম অয়েলের দেখা মিলেছে। তাও বিক্রি হচ্ছে নির্ধারিত মূল্যের চাইতে বেশি দামে। তবে সরবরাহ এবং বিক্রি স্বাভাবিক রয়েছে সরিষা, রাইস ব্যান এবং সূর্যমুখী তেলের। তবে সেসবের ক্রেতা খুবই কম।

বাজারের বেশ কয়েকজন বিক্রেতা বলেন, তেলের মিল তো বন্ধ করে রাখেনি। ঠিকই তেল উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু দাম বাড়ানোর জন্য মিল থেকেই তেল ছাড়ছে না। তাই বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। আমাদের কাছে যা ছিল সবই বিক্রি হয়ে গেছে। নতুন করে তেলের অর্ডার দিলেও ডিলাররা এখনো দিয়ে যায়নি।

তারা বলেন, বাজারে তেল নেই। নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতার জন্য রাখতে হয়েছে। তেল না থাকলে ক্রেতারা চলে যাবে। তেলের সঙ্গে অন্যান্য পণ্যও বিক্রি করতে হয়।

তারা আরও বলেন, রোজার মাসেও ১৬৫ টাকা লিটার বোতল বিক্রি করেছি। এখন ২০০ টাকা লিটার বিক্রি করতে হচ্ছে। ক্রেতাদের সুবিধার জন্য ২ লিটারের বেশি তেলের বোতল বিক্রি করছি না।

দ্বিগুবাবু বাজারের নেপাল স্টোরের মালিক শংকর চন্দ্র পোদ্দার বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের ৫ লিটারের তেলের বোতল ১ হাজার টাকা। এমআরপি রেটে বেচার সুযোগ নাই। এক লিটার ২১০ টাকা। বাজারে তেল নাই। বাড়তি দাম দিয়া আমরা কিনে আনছি। এভাবেই বেচতে হবে।

এদিকে ত্রাহি অবস্থায় থাকা ক্ষুব্ধ ক্রেতারা জানান, তেলের দাম ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েও তাদের আশা মেটেনি। আরও দাম বাড়ানোর জন্যই তারা কৃত্রিমভাবে তেলের সংকট তৈরি করেছে।

তারা বলেন, ভেবেছিলাম সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে। কিন্তু সরকার তা না করে বরং ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের পক্ষেই কথা বলছে। তেলের দাম বাড়লে আমরা সাধারণ জনগণ কীভাবে চলব সেটা একটু চিন্তা করে না।

অপরদিকে ব্যবসায়ীরা ডিলারদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, গত ২৫ তারিখ থেকে এখন পর্যন্ত একজন ডিলারেরও দেখা নাই। তীর, রূপচাঁদা আর বসুন্ধরা গ্রুপ এই বাজারে তেল দিত। এখন একটা কোম্পানিও আসে না। টিভিতে দেখি তেল নাকি পর্যাপ্ত। তাহলে আমরা কেন তেল পাই না? এর কারণ ঈদের আগে তেল না দিয়ে তারা বোতলের তেলকে লুজ তেলে পরিণত করেছে আর বেশি দামে বিক্রি করেছে।

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার তীর সয়াবিন তেলের একমাত্র ডিলার মনির স্টোরের পক্ষ থেকে মুরাদ হোসেন জানান, ঈদের ১ সপ্তাহ আগেই আমরা তেল সরবরাহ বন্ধ করেছি এমন অভিযোগটি সঠিক নয়। তবে ঈদের ২-৩ দিন আগে আমাদের কাছে তেল ছিল না, কারণ কোম্পানি থেকেই আমরা তেল পাইনি, তাই দিতে পারিনি।

বোতলজাত তেলকে লুজ তেলে পরিণত করে বিক্রি করা হয়েছে- এমন অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে এমন কোনো কাজ করা হয়নি। তবে কেউ করেছে কিনা সে ব্যাপারে আমি না জেনে বলতে পারব না। তবে এখন তেল সরবরাহ স্বাভাবিক বলেও দাবি করেন তিনি।- যুগান্তর

               

সর্বশেষ নিউজ