আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপ। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে মুখোমুখি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নেই। চলছে পূর্ণশক্তি নিয়ে রাজপথ দখলের লড়াই। বিএনপি ঘোষণা করেছে সরকার পতনের ১০ দফা ও নতুন কর্মসূচি।
সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন দলটির এমপিরা। তবে এসব দাবি ও কর্মসূচিকে আমলে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীনরা। উলটো বিএনপিকে মোকাবিলায় নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
এমন অনড় অবস্থানের মধ্যে ২৪ ডিসেম্বর রাজপথে মুখোমুখি হচ্ছে দুদল। ওইদিন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। নতুন কর্মসূচি নিয়ে যুগপৎভাবে রাজপথে নামবে বিএনপি।
ঢাকাসহ সারা দেশে গণমিছিলের ঘোষণা দিয়েছে দলটি। রাজপথে থাকবে জামায়াতও। এমন পরিস্থিতিতে রাজনীতি ফের উত্তপ্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
তাদের আরও অভিমত-দুদলের অনড় অবস্থানে রাজনৈতিক উত্তাপ ইতোমধ্যে সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে তা আরও ভয়াবহ হতে পারে।
রাজনৈতিক সংঘাতের এ প্রভাব পড়তে পারে দেশের অর্থনীতিতেও। যা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরও তীব্র করে তুলবে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সমঝোতার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তারা।
তাদের মতে, রাজনীতিতে মতের অমিল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আলোচনার মাধ্যমে সেটার সমাধান করতে হবে। অনেক সময় রাজপথে রাজনৈতিক সমাধান হয়। কিন্তু সেটা কখনো শান্তিপূর্ণ হয় না।
তাতে ক্ষতি হতে পারে রাষ্ট্রের সম্পদ এবং ঘটতে পারে ব্যাপক প্রাণহানি। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজপথের লড়াইয়ে না গিয়ে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, দেশের বড় দুটি দল একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতি করে আসছে।
বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যেই এ হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
আবার বর্তমান সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে তারা ভিন্নভাবে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছে। তাদের এ রাজনীতি দেশকে একটা বারুদের স্তূপের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
এখন যে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল একটা দিয়াশলাই ছুড়ে দিয়ে দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। এ সংকট থেকে উত্তরণে আমাদের রাজনৈতিক সমঝোতা জরুরিভাবে প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকরা জানান, অতীতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে বলা যায়, সামনে ভালো কোনো খবর নেই। নির্বাচনকে সামনে রেখে দুদল আরও বেশি মারমুখী ও আগ্রাসী হয়ে উঠছে।
নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুর সহজে সমাধান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ নিয়ে ক্ষমতাসীনরা ছাড় দেবে বলে মনে হচ্ছে না। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে তারা অনড়।
সব দল নির্বাচনে এলো কিনা-সেটা বিবেচনায় নেওয়ার ভাবনা সরকারের মধ্যে আপাতত নেই। অন্যদিকে বিএনপিও তাদের অবস্থানে অনড়।
ঢাকার সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলেও নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও সংঘর্ষের ঘটনা ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে আরও জটিল করবে। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করছে তারা। এ লক্ষ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
রাজপথে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এ দাবি আদায় করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তাদের সেই দাবি সহজেই সরকার মেনে নেবে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে সংঘাত অনিবার্য। সেই সংঘাত কতটা ভয়াবহ রূপ নেয় তা নিয়ে আছে নানা শঙ্কা।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় না তারা দেশের কথা কিংবা জনগণের কথা ভাবছে। দলীয় স্বার্থের বাইরে যাওয়ার মানসিকতা তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
করোনার ভয়াবহতার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সারা বিশ্বের অর্থনীতি টালমাটাল। যার ঢেউ লেগেছে আমাদের দেশেও। সবকিছুর মূল্য বেড়ে গেছে। সাধারণ মানুষের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
সামনের বছরে ভয়াবহ মন্দা আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।
যা আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে দেবে। সাধারণ মানুষের জীবন হবে আরও দুর্বিষহ।
জানতে চাইলে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দুদলের অনড় অবস্থানে রাজপথে সংঘাত হবে এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই।
দেশবাসীর প্রত্যাশা, তারা সংঘাত-সহিংসতার পথ পরিহার করবে। রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মকাণ্ড চালাবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংঘাতে সব সময় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি নানা সংকটে জর্জরিত।
এরপর রাজনৈতিক সংকট তা অনেকটা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়াবে। সব পক্ষকে এ বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে।
২৪ ডিসেম্বর ফের মুখোমুখি দুদল : বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার পারদ এখনো শেষ হয়নি। এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজপথে শুধু সহিংসতাই ঘটেনি, ঝরেছে রক্তও।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ সিনিয়র অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা এখনো কারাগারে।
সরকারের কঠোর অবস্থানের মধ্যেই ফের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। এবার একা নয়, সমমনা ও সরকারবিরোধী সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে রাজপথে নামছে দলটি। ঘোষণা করেছে যুগপৎ আন্দোলনেরও।
২৪ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশে গণমিছিলের মধ্য দিয়ে মাঠে নামবে তারা। দীর্ঘদিন পর জামায়াতও ঘোষণা দিয়ে রাজপথে নামছে। একইদিন তারাও সারা দেশে গণমিছিল করবে।
এদিকে ২৪ ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। যা আগে থেকেই নির্ধারিত। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ওইদিন সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীরা ঢাকায় আসবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও নেতাকর্মীদের উপস্থিতি আশপাশের সড়ক ছাড়িয়ে যাবে।
একইদিনে দুদলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে ফের উত্তেজনার আশঙ্কা করছেন অনেকে। এ আশঙ্কার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে জামায়াতের মাঠে নামার ঘোষণা।
দীর্ঘদিন পর জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে রাজপথের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নামলেও তারা অনেকটা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।
বিএনপির ঘোষিত ১০ দফা ও সরকার পতনের নতুন কর্মসূচিকে সরাসরি সমর্থন দেয়নি দলটি। তারা নিজেদের মতো করে ১০ দফা দাবি ও কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াত একইদিনে মাঠে নামার ঘোষণায় সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে।
-jugantor