২, মে, ২০২৪, বৃহস্পতিবার
     

এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাকিমপুর শিকদার বাড়িতে দুর্গোৎসব

এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট:
কারিগরদের নিপুণ হাতের ছোঁয়া আর তুলির আঁচড়ে সেখানে দেব-দেবীর প্রতিমা এমনভাবে সাজানো হয়েছে দেখলে মনে হবে জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুক্রবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে যাচ্ছে। পঞ্জিকা অনুযায়ী দেবী দুর্গা ঘোড়াই চড়ে আসবেন এবং একই বাহনে বিজয়া দশমীতে ফিরে যাবেন শ্বশুরালয়ে।

শুক্রবার (২০ অক্টোবর) ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে এ উৎসব।

কোভিড মহামারির কারণে বাগেরহাট সদর উপজেলার হাকিমপুর গ্রামের শিকদার বাড়িতে গত তিন বছর উৎসব বন্ধ ছিল। বিখ্যাত মণ্ডপটি এবার ৫০১টি প্রতিমা নিয়ে আগের রূপে ফিরছে। গ্রামের শিল্পপতি লিটন শিকদার সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়িতে দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন।

যদিও মহামারির সময় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে সমুন্নত রাখার জন্য ছোট পরিসরে পূজার আয়োজন করা হয়েছিল। এ বছর আগের মতোই জাঁকজমকপূর্ণ পূজা উদযাপন করতে যাচ্ছে শিকদার বাড়ি।

শিকদার বাড়ি পূজামণ্ডপে মোট ৫০১টি দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরি করা হয়েছে। একাদশ প্রহরে মণ্ডপে প্রতিমা সাজানোর কাজ চলছে। দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করতে প্রতিমাগুলোতে নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে।

এদিকে আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে মহামায়া দেবী দুর্গার সঙ্গী হিসেবে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগের দেব-দেবীরা পূজামণ্ডপ জুড়ে বিস্তৃত। কারিগরদের নিপুণ হাতের ছোঁয়া আর তুলির আঁচড়ে সেখানে দেব-দেবীর প্রতিমা এমনভাবে সাজানো হয়েছে দেখলে মনে হবে জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।

তিন বছর পর শিকদার বাড়ির দুর্গোৎসব বড় পরিসরে আয়োজনের খবরে দর্শনার্থী আর ভক্তকুলের মধ্যে উৎসব ছড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে দর্শনার্থীরা আসতে শুরু করেছে পূজামণ্ডপে।

দেব-দেবীর প্রতিমা এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে দেখলে মনে হবে যেন স্বর্গরাজ্য। দেব-দেবীরা মা দুর্গার সঙ্গী হয়ে ধরাধামে এসেছেন একসঙ্গে। মহিষাসুরকে যেভাবে বধ করেছিলেন দেবী দুর্গা, তা দেখানো হয়েছে প্রতিমার মাধ্যমে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তুলে ধরা হয়েছে প্রতিমায়।

কারিগররা (ভাস্কর) তাদের হাতের নিপুণ ছোঁয়া আর রং তুলিতে অপরূপ সাজে প্রতিমা সাজিয়েছেন।

বিশাল পূজামণ্ডপটি ঘুরে দেখা গেছে, ঘোড়ায় চড়ে দুর্গার মর্ত্যলোকে আগমন ও গমন, বিভিন্ন দেব-দেবীর সৃষ্টির রহস্য, নারায়ণের অনন্ত শয্যা, সমুদ্র মন্থন, সীতা হরণ, শ্রীকৃষের অষ্টসখী, ৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের কুম্ভকর্ণের প্রতিমূর্তি।

জানা গেছে, বাগেরহাট সদর উপজেলার হাকিমপুর গ্রামে শিকদার বাড়ির পারিবারিক এই পূজামণ্ডপে ২০১১ সালে ২৫১টি প্রতিমা সাজিয়ে প্রথম দুর্গোৎসব শুরু হয়। এরপর প্রতি বছর বেড়েছে প্রতিমার সংখ্যা।

সর্বশেষ ২০১৯ সালে ৮০১টি দেব-দেবীর প্রতিমা সাজিয়ে দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল।

আয়োজক পরিবারের সদস্য শিশির শিকদার জানান, কোভিডের জন্য গত তিন বছর শুধু ধর্মীয় রীতি রক্ষায় পূজা করলেও দুর্গোৎসব করতে পারিনি। এ বছর আগের মতো ধুমধাম করে দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, সানাতন ধর্ম সম্পর্কে মানুষকে উজ্জীবিত করতে তার স্বর্গীয় বাবা ডা. দুলাল কৃষ্ণ শিকদার বৃহত্তর পরিসরে দুর্গোৎসব শুরু করে গেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও বড় পরিসরে দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।

শিশির শিকদার জানান, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেচ্ছাসেবক বাহিনী দিয়ে নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১০০টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। তল্লাশির মধ্য দিয়ে দর্শনার্থীদের পূজামণ্ডপে প্রবেশ করতে হবে।

বাগেরহাট জেলা পূজা উযদাপন পরিষদের সভাপতি নিলয় কুমার ভদ্র দাবি করেন, পারিবারিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গোৎসব শিকাদার বাড়ি পূজামণ্ডপ। দেশ-বিদেশের কয়েক লাখ ভক্ত ও দর্শর্ণার্থী এই দুর্গোৎসবে আসেন।

প্রতিমার কারিগর (ভাস্কর) বিজয় কৃষ্ণ বাছাড় জানান, পাঁচ মাস ধরে ১৫ জন মিলে শিকদার বাড়ির এই পূজামণ্ডপে বিভিন্ন ৫০১টি প্রতিমা তৈরি করেছেন। দেশি-বিদেশি নানা রঙ আর অলংকার দিয়ে প্রতিমা সাজানো হয়েছে। প্রতিমায় সোনালি রঙ করা হয়েছে। ৯ ফুট থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার প্রতিমায় রেডিএস কালার ব্যবহার করা হয়েছে।

বাগেরহাটের পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খান জানান, শিকদার বাড়ি দুর্গোৎসবে পুলিশের পক্ষ থেকে কয়েক স্তরে নিরাপত্তা দেওয়া হবে। সাদা পোশাকেও পুলিশ সেখানে মোতায়েন থাকবে।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন জানান, দুর্গাপূজা উৎসবমুখর এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

বাগেরহাট সদর, কচুয়া, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা, রামপাল, ফকিরহাট, মোল্লাহাট ও চিতলমারী উপজেলা মিলে জেলার ৯টি উপজেলায় এ বছর ৬৫২টি পূজা মণ্ডপে দুর্গা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও নানান দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রতিবছর এই পূজা দেখতে আসেন। করোনার জন্য বিগত তিন বছর সংক্ষিপ্ত আকারে পূজা উদযাপন করলেও এবছর আবার জাঁকজমকভাবে এই বাড়িতে পূজার আয়োজন হয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে ১৫ জন কারিগর দিনরাত পরিশ্রম করে প্রতিমা তৈরি করে তাদের সর্বোচ্চ পরিশ্রম উপহার দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ইতোমধ্যে এই পূজার আয়োজক বিশিষ্ট শিল্পপতি লিটন শিকদার নিজে উপস্হিত থেকে নির্দেশনা দিয়েছেন কারিগর ও সাজসজ্জাকারদের।

আয়োজক লিটন শিকদার জানান, এ বছরেও তাদের পূজা মন্ডপে দেশ-বিদেশ থেকে কয়েক লক্ষ লোকের সমাগম হবে বলে আশা করছেন তিনি। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা স্হাপন করা হয়েছে। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রশাসনিক নিরাপত্তা গ্রহণ করা হয়েছে। নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, ইউ পি সদস্য এবং স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি রয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিন্তে র‌্যাব, বিজিবি, আনসারসহ অন্যান্য বাহিনীর সার্বক্ষণিক টহল নিশ্চিত করা হবে বলে প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে।

               

সর্বশেষ নিউজ