৭, মে, ২০২৪, মঙ্গলবার
     

ফুটপাত যেন ‘সোনার ডিম’

নারায়ণগঞ্জে সদ্যসমাপ্ত রমজান মাসে নগরীর ফুটপাত ও সড়ক দখল করে থাকা প্রায় ৮ হাজার হকারের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। এদের মধ্যে শুধুমাত্র কয়েক হাজার মৌসুমি হকারের কাছ থেকেই রোজার ১ মাসের জন্য ‘সেলামি’ বাবদ উঠেছে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা।

ফুটপাতের এই চাঁদা ও সেলামির ভাগ গেছে পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, হকার নেতা, ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের পকেটে। গেল রোজায় নগরীজুড়ে কয়েক হাজার হকারদের কারণে লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা যেমন ছিল দুর্বিষহ তেমনি তীব্র যানজটের কারণে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সবার। তবে রহস্যজনক কারণে হকার প্রসঙ্গে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা।

রমজানজুড়ে খোদ নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার আশপাশে কমপক্ষে ১ হাজার হকার বসলেও সদর থানার ওসি শাহজামান উল্টো বলেছেন- ‘আমরা প্রতিদিনই হকার উচ্ছেদ করছি’।

অভিযোগ রয়েছে, নগরীর ২নং ও ১নং রেলগেট এলাকার হকারদের টাকা নিতে রীতিমতো এলাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন সরকারি দলের কয়েক নেতা। এদের মধ্যে বামপন্থি রাজনীতি করেন এমন এক নেতাও রয়েছেন, যিনি নাসিকের একজন কাউন্সিলরের পিএস পরিচয় দিয়ে থাকেন।

জানা গেছে, প্রতি বছরই ঈদকে কেন্দ্র করে রমজানের শুরু থেকেই প্রায় ৫ হাজার নিয়মিত হকারের পাশাপাশি পুরো নগরী দখল করে রাখে কমপক্ষে আরও ৩ হাজার মৌসুমি হকার। করোনার কারণে ২ বছর পর প্রাণখুলে ঈদ উদযাপনের জন্য বিশেষ করে যানজট নিরসনের জন্য শুরু থেকেই নগরবাসীর আহবান ছিল জেলা পুলিশের প্রতি।

সেই কথা মাথায় রেখে গত ৩০ মার্চ পবিত্র রমজান মাসে নগরবাসীকে যানজটের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা পুলিশকে ১০ লাখ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান।

ওই চেক প্রদান অনুষ্ঠানে এমপি সেলিম ওসমান পুলিশের প্রতি অনুরোধ রেখে বলেন, রমজান মাসে যাতে নগরবাসীকে যানজটের দুর্ভোগ না পোহাতে হয়, ফুটপাতে যেন কোন দোকানপাট বসতে না পারে সে ব্যাপারে পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ঘটনার ২ দিনের মাথায় রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে মাঠে নামে জেলা পুলিশের কর্তারা। মাত্র ২৪ ঘণ্টায় তারা ফুটপাত হকারমুক্ত করে নগরীর চিত্র বদলে ফেলেন। জাতীয় গণমাধ্যমে পর্যন্ত উঠে আসে পুলিশের প্রচেষ্টায় এ যানজটমুক্ত নারায়ণগঞ্জ নগরীর চিত্র। কিন্তু মাত্র ৭ দিনের মাথায় নারায়ণগঞ্জ চলে আসে সেই চেনা রূপে। ফুটপাতের হাজার হাজার হকার রীতিমতো নাভিশ্বাস তোলে নগরবাসীর। মাত্র ১০ মিনিটের হাঁটা রাস্তা পাড়ি দিতে নগরবাসীর সময় লাগে প্রায় ৪০ মিনিট।

সরেজমিন জানা গেছে, গেল ঈদকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু রোডের চাষাঢ়া এলাকা থেকে ২নং রেলগেট হয়ে ডিআইটি পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে অবস্থান নিয়েছিল কমপক্ষে ৪ হাজার হকার। এর মধ্যে জামা কাপড়, জুতা, ক্রোকারিজ, মসলা আর শুটকির দোকান থেকে শুরু করে যৌনবর্ধক নিষিদ্ধ ওষুধের দোকান পর্যন্ত বসানো হয়েছিল ফুটপাতে।

নগরীর সলিমুল্লাহ সড়কে হকারের এতটাই আধিক্য যে, এই সড়কে গত ২২ রমজান থেকে যানবাহন চলাচল অনেকটাই ছিল বন্ধ। এছাড়াও শহরের কালীরবাজার, ১নং রেলগেট, ফলপট্টি, টানবাজার, ২নং রেলগেট এলাকায় বসেছিলেন আরও প্রায় ৪ হাজার হকার।

নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় শত শত হকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আলাপ করে জানা গেছে চমকপ্রদ তথ্য।

চাষাঢ়া রাস্তার পাশে ফুটপাতে ছেলেদের শার্ট, টি-শার্ট, প্যান্ট বিক্রি করেছেন মৌসুমি হকার আলমগীর। তিনি জানান, এখানে ৪ ফিট বাই ৩ ফিট জায়গা নিতে আমাকে রমজান মাসের জন্য ১৭০০ টাকা দিতে হয়েছে। বেচাকেনা হোক বা না হোক, প্রতিদিনই পুলিশকে দিতে হয়েছে ১০০ টাকা আর হকার নেতাদের ১০০ টাকা। এছাড়া এলাকাভিত্তিক ছিঁচকে নেতাদেরও টাকা দিতে হচ্ছে।

আলমগীরের মতো অনেকেই ছিলেন এখানে মৌসুমি হকার। তারা জানিয়েছেন, যারা নিয়মিত হকার তাদের এই সেলামি দিতে হয় না, তবে হকার নেতা ও পুলিশকে টাকা দিতে হয়। সেলামির টাকা ব্যবসার প্রকার ভেদে ৫০০ থেকে ২০০০ টাকাও হয়।

কথা বলে জানা গেছে, চাঁদার টাকার পরিমাণেও ভিন্নতা রয়েছে। যারা শরবত বিক্রি করেন তাদের দিতে হয় ৫০ থেকে ৮০ টাকা। যারা ডিম বিক্রি করেন তাদের দিতে হয় ১০০ থেকে ১২০ টাকা। যারা একটু বড় করে জামা-কাপড় বিক্রির পসরা সাজান, তাদের দিতে হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। হকারদের দাবি পুলিশের পাশাপাশি এই চাঁদা যায় বেশ কয়েকজন হকার নেতা ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার পকেটে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২নং রেলগেট এলাকার কয়েকজন হকার নেতা জানান, এই এলাকার ফুটপাত বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা আছে। শহরের সৈয়দ আলী চেম্বার, ফজর আলী টাওয়ার এলাকা ভাগাভাগি করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের প্রথমসারির ২ নেতা। এছাড়া নগরীর ১৫নং ওয়ার্ডের বেশ কিছু এলাকার হকারের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলেন বামপন্থি এক নেতা, যিনি নিজেকে এক কাউন্সিলরের পিএস পরিচয় দিয়ে থাকেন।

এছাড়া নগরীর একটি বড় অংশের চাঁদা উত্তোলনের দায়িত্বে থাকেন ১০ জন হকার নেতা। এরা হলেন- হকার সমিতির সভাপতি রহিম মুন্সী, কোষাধ্যক্ষ আনোয়ার মুন্সী, হকার নেতা দুলাল মুন্সী, আসাদ, তার শ্যালক আলী, মিলন, মহসীনসহ কয়েকজন। যারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ফুটপাতের এরিয়া অনুযায়ী চাঁদা উত্তোলন করে থাকেন।

ঈদ উপলক্ষে হকারদের চাঁদার পরিমাণ কোথাও দ্বিগুণ, কোথাও ৩ গুণ ছিল। নিয়মিত হকারদেরও ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত চাঁদা দিতে হয়েছে।

এদিকে অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ৫ হাজার নিয়মিত হকারের বাইরে প্রায় ৩ হাজার মৌসুমি হকারের কাছ থেকে রোজার ১ মাসের জন্য নেওয়া হয়েছে গড়ে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা। সেই হিসাবে এ সেলামির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। আর মোট ৮ হাজার হকারের কাছ থেকে পুরো রোজার মাসে দৈনিক গড়ে ১০০ টাকা হারে চাঁদা উঠেছে প্রায় ৮ লাখ টাকা। সেই হিসাবে পুরো মাসের চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এছাড়া এলাকাভিত্তিক ছিঁচকে সন্ত্রাসী বা কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত তো ছিলই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিপুল পরিমাণ এই চাঁদার টাকা গিয়েছে পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, হকার নেতা, ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের পকেটে।

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি শাহজামান পুলিশের চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করে বলেন, যে পুলিশ সদস্য চাঁদা নিয়েছে তার নাম লিখে নিউজ করে দিন।

রোজায় থানা এলাকার আশপাশে শত শত হকার কিভাবে ব্যবসা করেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিনই হকার উচ্ছেদ করেছি।

এ ব্যাপারে হকার নেতা আসাদ, রহিম মুন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা সরাসরি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।- যুগান্তর

               

সর্বশেষ নিউজ